
গাইবান্ধার ঐতিহ্যবাহী রসমঞ্জুরি
বিরাট রাজার বেঁধে রাখা মাঠের পর মাঠে শত শত গাভীর বাথান। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হাত ধরে কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেনের ক্যু-ঝিক-ঝিক চলাচল। মাঝে তিস্তা-যমুনার বুকে দেওয়ানগঞ্জ-জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটে স্টিমার। হারিয়ে যাওয়া সেই সব স্মৃতি হাতড়ানোর মতো মানুষও আজ বিরল। স্মৃতির পটে রেলের ফুলছড়িঘাট, বালাশীর ঘাট, তিস্তামুখঘাট, বাহাদুরাবাদঘাট আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। ইতিহাস কখনো হারিয়ে যায় না। ওইসব ঘাটের নাম এখনো বিরাজমান থাকলেও নেই কোনো কার্যক্রম।
উত্তরাঞ্চলের সেসব স্মৃতি হারিয়ে যেতে বসলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে গাইবান্ধার রসনা বিলাসীদের জন্য সেই আসম-বেঙ্গল কারিগরদের রেখে যাওয়া রসমঞ্জুরির হাট। রসমঞ্জুরির সঙ্গে কৃষকের উৎপাদিত ফসল ঘিরে উত্তরের গাইবান্ধা জেলাকে পরিচিত করতে তিনটি পণ্যকে দিয়ে ব্র্যান্ডিং করছে জেলা প্রশাসন। পণ্য তিনটি হলো রসমঞ্জুরি, মরিচ ও ভুট্টা। তিনটি পণ্য নিয়ে স্লোগানও তৈরি করা হয়েছে-‘ স্বাদে ভরা রসমঞ্জুরির ঘ্রাণ, চরাঞ্চলের ভুট্টা-মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ’।
বলা হয়ে থাকে যে, মহাভারত রচনার প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে (বর্তমান) গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় এক হিন্দু রাজার প্রাসাদ ছিল। তার নাম ছিল রাজা বিরাট। ঘাঘট নদী তীরবর্তী এ ভূখ- (বর্তমান গাইবান্ধা শহর) ছিল তার রাজত্বভুক্ত পতিত তৃণভূমি। তিনি এই তৃণভূমিকে গোচারণ ক্ষেত্র ও গাভীর বাথান হিসেবে ব্যবহার করতেন। এখানে গাভীগুলো বাঁধা থাকত বলে এ অঞ্চলের নাম হয়ে যায় গাইবান্ধা।
গাইবান্ধা নাম নিয়ে রয়েছে আরও অনেক কথা। ১৮৭৫ সালের পূর্বে গাইবান্ধা নামে এতদাঞ্চলে তৎকালীন সরকারের কোনো ইউনিট ছিল না। রংপুর জেলায় সাদুল্যাপুর ও ভবানীগঞ্জ থানা নিয়ে ১৮৫৮ সালে ২৭ আগস্ট ভবানীগঞ্জ নামে একটি মহকুমা গঠিত হয়। ১৮৭৫ সালে ভবানীগঞ্জ মহকুমা নদীভাঙনের কবলে পড়লে মহকুমা সদর ঘাঘট নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধায় স্থানান্তরিত করা হয়। পরে এর নাম পরিবর্তন করে গাইবান্ধা মহকুমা নামকরণ করা হয়। আশির দশকে মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলা হয়।
রেল সূত্র জানায়, ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগের জন্য গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদঘাট দিয়ে যমুনা নদীতে রেল ফেরি সার্ভিস চালু করে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তিস্তামুখ ঘাটে রেলওয়ে মেরিন বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। রেলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতে থাকে যমুনা নদীর ওপর দিয়ে যাত্রী ও পণ্যবাহী ওয়াগন পারাপার। তৎকালীন তিস্তামুখ ঘাট-বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে যাত্রী পারাপার ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে মেরিন বিভাগের কার্যক্রম শুরু করা হয়।
১৯৩৮ সাল থেকে নিয়মিত নদীপথে ফেরি চলাচল করলেও ১৯৯০ সালে যমুনা নদীর নাব্য সংকটে ফেরি সার্ভিসটি তিস্তামুখ ঘাট থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে একই উপজেলার কঞ্চিপাড়ার বালাসী ঘাটে স্থানান্তর করা হয়। ত্রিমোহিনী স্টেশন থেকে বালাসী পর্যন্ত নতুন করে রেলপথ নির্মাণ করা হয়। বালাসী ঘাট চালুর পরপরই নির্মিত হয় যমুনা সেতু। তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় এ রুট। তিস্তামুখ ফেরিঘাটও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
স্টিমার পারাপারে ট্রেন চলাচলের স্মৃতি জানতে চাইলে গাইবান্ধার প্রবীণ ব্যক্তি রেজাউল হক জানালেন দিনাজপুর থেকে ছেড়ে গাইবান্ধা ও বোনারপাড়া জংশন হয়ে ফুলছড়ি ঘাটে যাত্রী নামিয়ে দিত চলাচল করত তিনটি ট্রেন। এরপর রেলের স্টিমারে ওপারে বাহাদুরবাদঘাটে গিয়ে পুনরায় ট্রেনে চেপে জামালপুর, ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা যাওয়া আসা করা হতো। ট্রেন তিনটির নাম ছিল- ঢাকা মেইল, দ্রুতযান ও উত্তরবঙ্গ মেইল। এরপর চালু হয় তিস্তা এক্সপ্রেস ও একতা এক্সপ্রেস।
তিনি বলেলন, এই পথে ট্রেনে সরাসরি চট্টগ্রামেও যাওয়া যেত। আজ সবই অতীত, আমাদের এপারে আর ওই সকল ট্রেন গাইবান্ধা দিয়ে এখন আর চলচল করে না। ঢাকা মেইল, উত্তরবঙ্গ মেইল ট্রেন দুটি আর নেই। তবে তিস্তা এক্সপ্রেস চলে ওপারের জামালগঞ্জ -ঢাকা, একতা ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস অন্যপথ দিয়ে ঢাকা যায়। আমরা নতুন করে পেয়েছি দুটি আন্তঃনগর লালমনি ও বুড়িমারী এক্সপ্রেস। তবে ঘাটপারাপার হওয়া লাগে। বগুড়া সান্তাহার হয়ে যমুনা ব্রিজ পার হয়ে যেতে হয়।
আরেক প্রবীণ ব্যক্তি গোবিন্দ লাল দাস জানালেন, সে সময় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের স্মৃতির সঙ্গে গাইবান্ধার ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছে রসনা বিলাসী রসমঞ্জুরি। কারণ ওই ক্যু-ঝিকঝিকের সঙ্গে রসমঞ্জুরির একটি যোগসূত্র ছিল। ট্রেনের যাত্রীদের জন্য ওই মিষ্টান্ন রেলস্টেশন বা নদী ঘাটেও বিক্রি হতো। ট্রেন যাত্রীরা সেই রসমঞ্জুরি মাটির হাঁড়িতে কিনে নিয়ে যেতেন। সেই মাটির হাড়িতে স্বযতেœ কোলে করে দড়ি বেঁধে বহন করা হতো।
সেই ইতিহাস সম্পর্কে তিনি জানালেন , ১৯৪৮ সালের জুন মাসে গাইবান্ধার সার্কুলার রোডে ‘রমেশ সুইটস’ এর কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষ প্রথম রসমঞ্জুরি তৈরি করেন। আসাম বেঙ্গল রেলের কারণে দেশ বিভাগের আগেই ওড়িশা থেকে আনা কারিগরদের সহায়তায় তিনি এই মিষ্টি তৈরির কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে এর বিশেষ স্বাদে মুগ্ধ হতে শুরু করে গাইবান্ধার মানুষ। রসমঞ্জুরি জনপ্রিয় হতে থাকে, আর এক সময় তা দেশের অন্যান্য অঞ্চল ও প্রবাসেও পরিচিতি লাভ করে।
প্রবীণ ব্যক্তির সূত্রধরে কথা বলা হয় রমেশ সুইটসের স্বত্বাধিকারী বলরাম ঘোষের সঙ্গে। তিনি বলেন , ‘দোকানটি ছিল আমার বোন জামাইয়ের। স্বর্গীয় রমেশ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন আমার বোনের শ্বশুর। তিনি মারা যাওয়ার পর দোকানটি সামলাতেন তার ছেলেরা। তারপর আমাদের হাতে আসে। আমরাই এখন পরিচালনা করছি, যোগ করেন তিনি। রসমঞ্জুরির খ্যাতি স¤পর্কে তিনি বলেন, আসামবেঙ্গল রেলের সূত্র ধরেই ‘ওড়িশা থেকে আমার বোনের শ্বশুর কারিগর নিয়ে রসমঞ্জুরি বানানো শুরু করেন। বানানো শুরু হওয়ার এক দশক মধ্যেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে সারা গাইবান্ধায়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এর খ্যাতি রয়েছে।’ আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল গাইবান্ধার ৭৭ বছরের ঐতিহ্য রসমঞ্জুরিকে জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু আজও সেই স্বীকৃতি গাইবান্ধাবাসী পায়নি। তবে রমেশবাবুর সেই মিষ্টান্ন এখন গাইবান্ধার সকল মিষ্টির দোকানেই তৈরি করে বিক্রি করেন।
বিরাটরাজার সেই গাই বা গাভীর কারণে গাইবান্ধায় সে সময় গরুর খাটি দুধের ঐতিহ্য আজও বিদ্যমান। ফলে এই মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই খাঁটি গরুর দুধ। শুরুর দিকে রসমঞ্জুরির আকৃতি ছিল লম্বাটে। পরে মানুষের পছন্দের কথা মাথায় রেখে তা ছোট ছোট গোলাকারে তৈরি করা হয়। দেখতে অনেকটা রসমালাইয়ের মতো হলেও প্রস্তুত প্রণালি ও স্বাদের কারণে তা আলাদা। রসমঞ্জুরির মূলে রয়েছে সঠিক অনুপাতের দুধ, ছানা, ক্ষীর, চিনি, ময়দা এবং এলাচের সংমিশ্রণ। এক কেজি রসমঞ্জুরি তৈরিতে প্রয়োজন হয় আড়াই কেজি দুধ, ২০০ গ্রাম ছানা, ১০০ গ্রাম চিনি, ২৫ গ্রাম ছানা ও সামান্য এলাচ। রমেশ সুইটসে দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে রসমঞ্জুরি তৈরি করে আসছেন গোবিন্দ চন্দ্র সরকার।
রসমঞ্জুরি প্রস্তুত প্রণালি স¤পর্কে তিনি জানান, প্রথমে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানানো হয়। এরপর মেশিন বা হাতে তৈরি ছোট ছোট ছানার বল চিনির সিরায় সিদ্ধ করা হয়। সিদ্ধ করার পর সেই বলগুলো ক্ষীরের মধ্যে রেখে কিছুক্ষণ জ্বাল দেওয়া হয়। এর ফলে রসমঞ্জুরি পায় স্বতন্ত্র এক স্বাদ। গোবিন্দ আরও জানান, অতীতে রসমঞ্জুরি সম্পূর্ণ হাতে বানানো হতো। তবে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি এবং অটোমেটিক মেশিন ব্যবহার করে এটি বানানো হয়। গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি শুধু একটি মিষ্টি নয়, এটি শহরের ঐতিহ্যের অংশ। এর স্বাদ এতটাই অনন্য যে না খেলে তা বোঝা সম্ভব নয়।
রমেশ সুইটসের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম ৩৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘সকালের নাশতায় রসমঞ্জুরির সঙ্গে পরোটা খুব জনপ্রিয়। এ ছাড়াও আমাদের এখানে ¯েপশাল এক ধরনের ডাল পাওয়া যায়, যা পরোটার সঙ্গে ফ্রি। এ ছাড়া বেলা ১১টা থেকে রাত পর্যন্ত নিমকি অথবা আলুর শিঙ্গারার সঙ্গে রসমঞ্জুরি খুব চলে এখানে। এখানে প্রায়ই খেতে আসেন আশরাফুল ইসলাম নামের এক স্কুল শিক্ষক। তিনি বলেন, আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় প্রথম বাবার সঙ্গে এখানে এসেছি। তখন পরোটা দিয়ে এই রসমঞ্জুরি খেতাম। এখনো সুযোগ পেলেই খেতে চলে আসি।
কর্মচারী রফিকুল ইসলাম জানান, এক কেজি রসমঞ্জুরি বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়। রসমঞ্জুরির পাশাপাশি এখানে ১৬ থেকে ১৭ পদের মিষ্টি পাওয়া যায়। এর মধ্যে মালাই চপ, দুধিয়া সন্দেশও খুব ¯েপশাল বলে জানান রফিকুল। যারা গাইবান্ধায় বেড়াতে আসেন তারা এই অনন্য মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করতে ভোলেন না। ফিরে যাওয়া পথে হাতে হাতে এই মিষ্টান্নের প্যাকেট। স্মৃতি কাঁদায়, স্মৃতি হাসায়- ফুলছড়ি-বালাসী-তিস্তামুখঘাটের গাইবান্ধার ঐতিহ্যের রসমঞ্জুরির প্রাণে।