
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতোমধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশাধিকার মাত্র ২০ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে প্রায় শতভাগ শিশুই প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে। ২০১০ সালে দেশে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা অংশগ্রহণে অভূতপূর্ব সমতা দেখা গেছে। তবে মাত্রার গুণগত মানে বড় চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। গত বছর ২০২৪ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি ও গণিতে কাক্সিক্ষত স্তরে পৌঁছায়নি। বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয় আমাদের পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাদানের ধরন এখনো যুগোপযোগী হয়নি। ১৯৮১ সালে প্রথম জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছিল। তবে নতুন প্রজন্মের প্রয়োজন মেটাতে তা সময়োপযোগী করার প্রয়োজন। শিক্ষকদের দক্ষতার ঘাটতি সমস্যা দীর্ঘদিনের। ২০১৮ সালে একটি সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষক পেশাগত প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত। ফলে শিক্ষাদানের মানে ব্যাপক ভিন্নতা দেখা দেয়। যেখানে উন্নত জেলা শহরে অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষিত ও সচেতন, সেখানে দূরবর্তী অঞ্চলে তা নেই। এই বৈষম্য শিক্ষার ফলাফলে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
গ্রামীণ অঞ্চলের অবকাঠামোও অনেক দুর্বল। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা রিপোর্ট বলেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ সরকারি স্কুলে স্যানিটেশন সুবিধা নেই, যা বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলে উপস্থিতি কমায়। বাংলাদেশ সরকার ‘স্কুল অবজারভেশন’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছে, কিন্তু কর্মসিদ্ধি এখনো অনেক দেরি। উচ্চশিক্ষায় সমস্যা আরও জটিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২ সালের এক গবেষণায় প্রকাশ পায়, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ সীমিত। অধিকাংশ শিক্ষার্থী শুধু সিলেবাস মুখস্ত করে পাস করে, প্রকৃত গবেষণা ও সৃজনশীলতার জায়গা পান না। এই কারণেই বাংলাদেশের গবেষণা প্রকাশনা আন্তর্জাতিক পত্রিকায় খুব কম আসে।
শিক্ষার বৈষম্যও বড় চ্যালেঞ্জ। শহর-গ্রাম, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে শিক্ষার সুযোগ ও গুণগত মানে বড় ফারাক রয়েছে। ২০১৯ সালে সরকারি একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকার অভিজাত এলাকায় প্রতি ১০০ জনে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের হার প্রায় ৭৫ শতাংশ, যেখানে নোয়াখালীর এক গ্রামে তা মাত্র ২০ শতাংশ। এ বৈষম্য কাটাতে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি ও বিশেষ কোচিং চালু হয়েছে, তবে ব্যাপকতা কম। ডিজিটাল শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে ২০২০-২১ সালে অনলাইনে ক্লাস চালুর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, সঠিক প্রযুক্তি থাকলে শিক্ষার গতিও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। সরকারি উদ্যোগে ২০২৩ থেকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট বিস্তার দ্রুত হচ্ছে।
সরকারের ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে ২০২২ সালের ‘নতুন শিক্ষানীতি ২০২২’ পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ফোকাস করা হচ্ছে পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল শিক্ষা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে। তবে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। অতএব, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাকে আধুনিকায়ন না করলে দেশের তরুণ প্রজন্ম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ও সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ
প্যানেল