ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

শিশুনাট্য ভাবনা

শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩

শিশুনাট্য ভাবনা

রহিম আব্দুর রহিমের নাটকসমগ্র

সম্প্রতি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘অভিযান’ থেকে ‘রহিম আব্দুর রহিমের নাটকসমগ্র’ গ্রন্থাকারে  প্রকাশ হয়েছে। বইটিতে তার রচিত ও নির্দেশিত বিভিন্ন সময় মঞ্চায়িত মোট ১৭টি শিশুতোষ নাটক স্থান পেয়েছে। নাটকগুলোর উপযোগিতা, পরিচিতি ও বিষয় বস্তু নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি।
‘বাইগারপাড়ের বাঙালি’ বাঙালির ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয়  চরিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শিল্প সাহিত্যের সকল শাখা তথা কবিতা, গান, নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য শিল্প,  চলচিত্র সর্বত্রই তার জীবন্ত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। টুঙ্গিপাড়ার মানচিত্র সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, বঙ্গবন্ধুর শৈশবের সঙ্গে যে নদীটির অবিচ্ছেদ্য স¤পর্ক, সেটির নাম বাইগার। কিশোর মুজিবের নেতৃত্ব গুণাবলীর বয়ান রহিম আব্দুর রহিমের নাটক ‘বাইগারপাড়ের বাঙালি’। কিশোর মুজিবের উচ্চ নৈতিকতা, সাহসিকতা, মানবিকতা ও দেশপ্রেম এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতার মতো বিষয়গুলো নাটকটিতে চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে। মানুষ বঙ্গবন্ধুকে জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে শিশুমনে এই নাটকটি ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম।  
‘পশুর বয়ান’ ‘আমি বাঘ, আমার একটা লেজ আছে, আমার লজ্জাও আছে। কিন্তু লেজহীন ওই মানুষদের লাজ লজ্জা নেই।’ অতি ক্ষুদ্রায়তন নাটক ‘পশুর বয়ান’ এ এই সংলাপটি শোনা যায় বাঘের কণ্ঠে। নাটকটির এই সংলাপটিই জানিয়ে দেয়, ক্ষমতা, আধিপত্য বিস্তার, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, স¤পদ বৃদ্ধির নেশা  ইত্যাদি কারণে মানুষ তার মানবিকতাকেই বিসর্জন দিয়েছে। এমনকি প্রকৃতি ও প্রাণী জগতের জন্যও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিক একটি পৃথিবীর পাবার আকুলতাই এই নাটকের প্রধান বিষয়। শুধু বিভিন্ন প্রাণী নয়, প্রকৃতিজুড়ে আকাশ-বাতাস-নদী- পাহাড়-অরণ্য জল সকলের বয়ানে এখানে এই সত্যই উচ্চারিত হয়েছে।
‘বল্টুর বিহা’ উত্তরাঞ্চলের ভাষায় বিবাহ বা বিয়ের প্রচলিত রূপ ‘বিহা’। আমাদের গ্রাম্য জনগোষ্ঠীর শ্রেণি চরিত্র ও আর্থ-সামাজিক চালচিত্র নিয়ে নকশাধর্মী  নাট্যকাহিনী বল্টুর বিহা।  
‘ইন্টারভিউ’, ‘ইট পাথরের কান্না’, ‘অসমাপ্ত আদালত’, ‘মিথ্যার পরিণাম’, ‘মিনার ভাঙ্গন’, ‘চেতনার মৃত্যু’, ‘ধিক্কার’, ‘ডানপিটেদের নাট্যশালা’ উপরের প্রত্যেকটিই ক্ষুদ্রায়তন এক একটি নাটকের শিরোনাম। বিষয় এবং চরিত্রের মধ্যে প্রকারভেদ থাকলেও ছোট ছোট এই নাটকগুলোর মূল উদ্দেশ্য সমাজে বিদ্যমান নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা এবং সমাজের মানুষের শুভবোধকে জাগিয়ে তোলা।  
‘সাতষট্টি’, ‘চুক্তির মুক্তি’ অতি ক্ষুদ্রায়তন তবে বক্তব্যধর্মী এই নাটক দুটিতে যুগ যুগ ধরে নাগরিকত্ব সুবিধাবঞ্চিত সাবেক ছিটমহলবাসীদের কথা উঠে এসেছে। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা ও এলাকা নির্ধারণ করা হয়। ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এলাকার ক্ষেত্রে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। ফলে ছিটমহলের বাসিন্দাগণ একদিকে নাগরিকত্ব সংকটে পতিত হন, অপরদিকে রাষ্ট্রীয় সকল সেবা থেকেও বঞ্চিত থাকেন। অবশেষে ২০১৫ সালে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হলে বিরাট একটি জনগোষ্ঠী কথিত ছিটমহল ট্র্যাজিডি থেকে অবমুক্ত হয়। সাতষট্টি এবং চুক্তির মুক্তি এই ইতিহাসেরই সংক্ষিপ্ত নাট্যালেখ্য।
‘রাসেল হত্যা’ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অভিশপ্ত দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার কনিষ্ঠ পুত্র শিশু রাসেলও এই নৃশংসতার শিকার হয়। এই নাটকে শিশু রাসেলের মৃত্যু পূর্ববর্তী  মুহূর্তগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে স্বজনদের কাছে পাওয়ার জন্য চিরন্তন শিশু হৃদয়ের তীব্র আকুলতা প্রকাশ হয়েছে।  
‘কে উত্তম’ এই নাটকটির ঘটনাবলি ব্যতিক্রমী একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ধর্মীয় শিক্ষাদানের নাম করে গড়ে তোলা এক শ্রেণির আবাসিক প্রতিষ্ঠানে কিছু ভ- হুজুর কর্তৃক শিশু নিপীড়নের ঘটনা আমাদের দেশে ব্যাপক। সংবাদ মাধ্যমেও হরহামেশাই এমন খবর প্রকাশিত হয়। এ জাতীয় একটি ঘটনাই এই নাটকের প্রধান বিষয়। একজন আবাসিক ছাত্রীকে দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন করে চলে এক ভ- হুজুর। প্রতিষ্ঠানে নবাগত একটি শিশু এই ঘটনা জেনে ফেলার কারণে শিশুটিকে কৌশলে বাইরে নিয়ে হত্যা করে মৃতদেহ লুকিয়ে রাখা হয়। তবে মৃতদেহ উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শিশুটির পোষা কুকুর টম। ধরা পড়ে মূল অপরাধী। নাটকটি সমাজ বাস্তবতা এবং শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে  সকলকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
রহিম আব্দুর রহিমের নাট্যভাবনা গবেষণালব্ধ পরীক্ষিত, অধিকতর উৎকর্ষের জায়গায় পৌঁছানো তার পক্ষে নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়।
(শফিকুল ইসলাম, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক)

×