ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমি অন্ধকারেই থাকি

মূল : অ্যানি আর্নো  অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

প্রকাশিত: ০১:২২, ১৭ মার্চ ২০২৩

আমি অন্ধকারেই থাকি

ঘোরগ্রস্ত কান্ডকারখানাগুলোর মিল খুঁজে পেতাম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পর্ব-১৫

ঘোরগ্রস্ত কান্ডকারখানাগুলোর মিল খুঁজে পেতাম। যখন তিনি আমার বাড়ি ছিলেন, সারাক্ষণ নিজের জিনিসগুলোকে উল্টেপাল্টে আবার গুছিয়ে রাখতেন, প্রায় দুই বছর যাবৎ এইসবই তিনি করেছিলেন। তেমনই আমার প্রেমিক ‘এ’-এর বাড়িতে দেখতাম, সেও তার লাইব্রেরিতে বইগুলো নামিয়ে ঘনঘন উল্টেপাল্টে আবার গুছিয়ে রাখত; তার ওই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদগুলোকে নেড়েচেড়ে এর ভেতর থেকে যেন স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নিত, ব্যাচেলর পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে সে যেন প্রতিনিয়ত এসব করেই যেত। আমার মা দুনিয়াকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়তবা নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইতেন-‘তিনি একজন মাথাপাগল মানুষ নন’। ওইসব দিনগুলো এখন কত দূরে হারিয়ে গেছে, যখন তিনি আমার কাছে থাকতেন। 
তাকে নিয়ে একটি সুন্দর স্মৃতি মনে পড়ছে: সেসব দিনে তিনি আবার সেলাই করার কথা ভাবলেন। শুরুও করেছিলেন কিন্তু প্রতিদিনই তার সুচগুলোর কিছু না কিছু হারিয়ে ফেলতেন, আবার সারাবাড়িময় খুঁজেও বেড়াতেন।
আর এখন আমার বয়েস যখন আঠারো, আমি তাকে প্রচ- ভালোবাসতাম। তিনি ছিলেন বিশাল কিছু, আমার জন্য একটি আশ্রয়স্থল। ওইসব দিনগুলোতে আমি ভীষণভাবে বুলিমিয়ায় ভুগতাম, তখন মা-ই ছিলেন আমার অভয়ারণ্য। 
বৃহস্পতিবার ১৯
আরেকদিন তিনি আমাকে জানালেন, আজকাল তার শরীর বেশ খারাপ লাগে। আমি তার দিকে আরেকটু মনোযোগী হলাম। তাকে লক্ষ্য করতাম যখন পাশে বসে থেকে খাইয়ে দিতাম, ঠিক ওই রকমভাবেই আমার ছোটছেলে এরিখকে যেভাবে খাওয়াতাম। এরিখের স্বভাব ছিল কোনো খাবার অপছন্দ হলে আমার চোখ লুকিয়ে ফেলে দেওয়া আর খেয়েছি বলে ‘ভান’ করা। 
আমি আমার মায়ের শিশু বয়সের কোনো ছবি দেখিনি। তার ছোটবেলার মুখটা কেমন ছিল জানি না। তার জীবনের প্রথম ছবিটা তার বিয়েরদিন তোলা হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় ছবিটাতে বেশ কয়েকবছর পরের একটি তারিখ দেওয়া, এক আত্মীয়ের বিয়েতে তুলেছিলেন। বেশ ভারী চোয়াল, ছোট্ট কপাল আর সব মিলিয়ে পরিশ্রমী ষাঁড়ের মতন দেখতে একটি মুখ। ছবিটাতে তাকে দেখে শুধু একটি কথাই মনে হবে– “তিনি এমন একজন নারী যিনি কোনো ধরনের কাগুজে প্রমাণ আর চিহ্ন না রেখে নিজের জীবনটা পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দিলেন”। 
তিনি সবাইকে শুধু দিতেই ভালোবাসতেন, কারো কাছ থেকে কিছু নিতে নয়, আর গ্রহণ করতেও অনিচ্ছুক ছিলেন। হয়ত মনোযোগ পেতেই এটা করতেন তিনি। নাকি চাইতেন কেউ তার এই ত্যাগটুকু লক্ষ্য করুক?
আমি যখন ছোট ছিলাম, আমিও দিতে ভালোবাসতাম- ভিউকার্ড, চকলেট বা যা-ই হোক না কেন, অন্যদের কাছে প্রিয় হতে, জনপ্রিয় হতে চাইতাম আমি, কিন্তু আমার এই লেখা, আমার সাহিত্যকর্ম আর লেখার এই বিশেষ ধরন বা রচনাশৈলীও কি দেওয়ার একটি বিশেষ উপায় নয়? সকলের জন্য? 
আমার ছোটবেলার একটি দৃশ্য, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, নগ্ন হয়ে, আমার বাবার মুখোমুখি, যিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। তিনি মাকে অবজ্ঞা করে বললেন, “তুমি বিশ্রী দেখতে”। 
তিনি ক্যাফেতে দুষ্টলোকদের গালি দিতেন- “তুই দূর হয়ে যা বুড়ো ফাজিল, নোংরা লোক”। (একই জিনিস বলতেন এলাকার কুত্তাগুলোকে যখন ওগুলো গরমের দিনে আমাদের কুত্তীগুলোকে তাড়া করে ফিরত) 

অক্টোবর, শুক্রবার ৪
লর্দেসের জলপর্বত নিয়ে তিনি সবাইকে যে গল্পটা শোনাবেন- আমি আমার দোরোখা কল্পনায় যেন তা দেখতে পাচ্ছি। লর্দেস এমন একটি জলগিরি যেখানে কেউ ডুবে গেলে মরেই যায়, আমারও মনে হয়েছিল তিনি সেখানে ডুব দিলে মরে যাবেন আর সকলের মতন।
আমার মনের ভাব- “আমিই তো তার একমাত্র শিশু”। 
তার ছিল জটিল করে গপ্প মারার ক্ষমতা আর আমার মনে হতো তিনি ভাব নিতে পছন্দ করেন, “কথায় কথায় শুধু দম্ভ দেখান”। 
যখন আমি টেলিভিশনে রুসিনের দ্য অস্ট্রিসসের এগ দেখেছিলাম- সেখানকার ওই মহিলা চরিত্রগুলোকে দেখতে আমার ভারি বিচ্ছিরি লাগত- যারা আমার মায়ের একেবারেই উলটো আর ঠিক বিপরীত। তাদের নারীসুলভ কমনীয় শরীর, বিলাসী হাবভাব আর ঝকঝকে মসৃণ ত্বক, শরীরের গড়ন, গায়ের পোশাক আর মুক্তোর অলংকার এবং তাদের সেই অভিনব অভিব্যক্তি- সব মিলিয়েই স্বপ্ন, ঠিক বাস্তব নয়, ভীষণ বিচ্ছিরি ব্যাপার। 
মঙ্গলবার ৮ 
তিনি হলরুমে ছিলেন। প্রথমে, আমি তাকে চিনতে পারছিলাম না। তার চুলগুলো পেছনে পনিটেল করে বাঁধা, আর মুখে ছিল স্থির অভিব্যক্তি। আমরা রুমে গেলাম, বিছানার উপরে রাখা আনেসি চিমনির বাঁকওয়ালা শোপিসটা দেখালাম তাকে, বললাম আনেসির এক বন্ধু তাকে পাঠিয়েছে। ওটার দিকে তিনি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, পরে বিড়বিড় করে বললেন, “আমারও এমন একটি ছিল”। আমি সবসময় ভাবি, তিনি এখন দুনিয়াটাকে কিভাবে দেখেন? তিনি সেই মহিলা, যিনি লাল পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতেন সাবলীল মেজাজে। এইসব ভাবলেই আমার কান্না পায়। কিন্তু আমি আজকাল আর তেমন করে ভাবিই না। আমি এখন তার সঙ্গে আছি, এটাই আসল। অন্তত আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। স্বরই আসল, সবকিছু। মৃত্যুর সবচেয়ে বাজে দিক হলো- কারো গলার আওয়াজ শুনতে না পাওয়া। শোনার উপায় না থাকা। 
তিনি এভাবে বলতেন এক সময়- “অমুক বেচারা নিজের কথা ভাবতে ভাবতেই মরে গেল। অথবা তমুক লোক ঐসব জিনিসে ডুবে থেকে তার সবকিছু হারালো”। এই মৃত্যু বা হারানো মানে হলো আকস্মিক বা হঠাৎ করেই চলে যাওয়া, অনেকটা স্বার্থপরের মতন আত্মকেন্দ্রিকভাবে একা একাই জীবনটা কাটানো আর মরে যাওয়া। 
মঙ্গলবার ১৫
অক্টোবরের একটি অনুজ্জ্বল সূর্যমরা দিন, ১৯৬২ সালের সেইদিনটির মতো, যেদিন আমি টিটিসিএল সনদটা পেয়েছিলাম। 
আজ তার রুমে ঢুকে আমরা মুখোমুখি বসলাম। তিনি একটা কাসটার্ড টার্ট খাচ্ছেন; তার হাত দুটো কাঁপছে, তিনি খাবারটা এক হাত থেকে আরেক হাতে, এভাবে ডান থেকে বাম হাতে উল্টেপাল্টে নিতে নিতে শেষ করলেন। বললেন, “আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলাম রে, বেশ কয়েকদিন কিছু খাইনি, জানিস! ওরা আমাকে অবহেলা করছে”। 
অবহেলা- ‘সেই চিরাচরিত অবমূল্যায়ন, বঞ্চনা আর অবহেলা’ তার মুখের কথা, মনের ঘোর। এর মানে হলো অর্থাভাব, যা এখন তার নেই, তবু তার এইসব অর্থহীন প্রলাপ আর এমনতরো কথাগুলো আমার ভেতরে অপরাধবোধই শুধু জাগিয়ে তোলে। 
তিনি বললেন, “ওখানে যদি ক্রিসমাসটা কাটাতে পারতাম! তাহলে কি চমৎকারটাই না হতো।” এবং আরো বললেন, “আমার এখানে আসতে তো তোর খুব বেশি সময় লাগে না, তাই না!” এর মানে হলো, যদি ইচ্ছে করে তাহলে তুমি তো ঘন ঘন আমাকে দেখতে আসতেই পারো। 
আজ রুমে ঢুকতেই যখন তিনি আমাকে প্রথম দেখলেন, তিনি অন্যান্য দর্শনার্থীদের মতনই আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন- “হ্যাঁ, বসে বসে আমি ভাবছিলাম, তুমি কখন আসবে!” সেই একই রকমের প্রবল আগ্রহ আর উদ্দীপনা এবং জ্যু’য় দি ভিভ্যরের (উৎফুল্লভাব) মতন, যেমনটা সব সময় ছিল তার মাঝে অতীত দিনে। করিডোরে হাঁটার সময়ে একজন বৃদ্ধা মহিলা তাকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, “এই যে, তুমি নিশ্চয়ই চলে যাচ্ছো না, তাই না? নাকি চলে যাচ্ছো তুমি?” তিনি খুব দ্রুত জবাব দিলেন, “মোটেই না। আমি কোথাও যাচ্ছি না। এখানেই আছি”। তিনি চান না আর কেউ তাকে বিরক্ত করুক। সামান্য একটু হলেও। (চলবে...)

×