ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমি অন্ধকারেই থাকি

মূল : অ্যানি আর্নো, অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১ ডিসেম্বর ২০২২

আমি অন্ধকারেই থাকি

এবছর সাহিত্যে নোবেল জয়ী ফরাসি লেখক অ্যানি আর্নো

বাংলা অনুবাদকের ভূমিকা : এবছর সাহিত্যে নোবেল জয়ী ফরাসি লেখক অ্যানি আর্নো। রুঁয়ো এবং বোর্দো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে পাঠ গ্রহণের পর তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। আর্নোর রচনাশৈলী মূলত স্মৃতিকথা নির্ভর আত্মজৈবনিক। নোবেলজয়ের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বলেন- লেখালেখি একটি রাজনৈতিক কাজ, যা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে উন্মোচিত হতে আগ্রহী করে তোলে। ভাষা ছুরির মতন ধারালো কিছু, এই ছুরি আমাদের বিভ্রম ও কল্পনার আবরণ ছিঁড়ে ফেলে সকলের চোখ খুলে দিতে পারে।
আর্নোর জন্ম ১৯৪০ সালে, লিলিবনের নরম্যান্ডিতে। বাবা-মা ক্যাফে ও গ্রোসারি শপ চালাতেন। তার লেখায় উঠে এসেছে নিজের গর্ভপাত প্রসঙ্গ, মায়ের আলঝেইমার ও ডিমেনশিয়া রোগে ভোগার স্মৃতি দিনলিপি। ‘আ ওমেনস স্টোরি’, ‘আ ম্যানস প্লেস’, ‘আই রিমেইন ইন ডার্কনেস’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য বই। ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বইগুলো বিশ্বব্যাপী পাঠকের মনে স্থান করে নিয়েছে, সমালোচকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
বাবার মতন তার মায়ের সঙ্গেও অ্যানি আর্নোর সম্পর্ক সহজ ছিল না- মা আর মেয়ে দুজনের মন, ব্যক্তিত্ব, ভালোলাগা আর মন্দলাগা, জীবনবোধ ছিল একেবারেই বিপরীত। ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর্নোর মা আলঝেইমার রোগে ভুগছিলেন, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। মায়ের অসুস্থতার সময় তাকে নিয়ে যে বই লিখতে শুরু করেছিলেন আর্নো, মা মারা যাওয়ার পর সেই পা-ুলিপিটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে তা নিয়ে আবার কাজ শুরু করেন। যা এক যুগ পর প্রকাশিত হয়েছে ফরাসি ভাষায়। মায়ের অসুস্থতার সময়ে হাসপাতাল ভিজিটের ছোট্ট ছোট্ট চিরকুটে রাখা ডায়েরি দিয়ে লিখেছিলেন বইটা। তা-ই ইংরেজি অনুবাদক তানিয়া লেসলির অনুবাদে ‘আই রিমেইন ইন ডার্কনেস’ শিরোনামে বিশ্ববাজারে এসেছিল, পাঠকের মন ছুঁয়ে ছিল।
মায়ের সঙ্গে আর্নোর সম্পর্ক যেমনই হোক, মা-ই ছিলেন তার ভেতরে সবচেয়ে কাছে। আর্নো লেখাতে, শব্দ বুনটে বলেছেনÑ ‘আমাদের দেখলে মনে হতে পারে, আমরা শুধু ঝগড়াই করি; অথচ পৃথিবীর যে কোনো স্থানে, ঘরে বাড়িতে মা মেয়ের সম্পর্ক তো এমনই’। এই ডায়েরি বইটিতে তার বিবিধ বইয়ের নাম এসেছে, মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটিকে নিরপেক্ষভাবে, ভালো মন্দের মিশেলে ফুটিয়ে তুলেছেন, আবেগের কাছে পরাস্ত না হয়ে।
বইটি অনুবাদ করতে অনেক ফেসবুক বন্ধু উৎসাহ দিয়েছেন। শ্রদ্ধাভাজন ‘গুলশান আখতার’ সর্বপ্রথম  পুরো বইটি অনুবাদ করে তাকে পড়তে দিতে বলেছিলেন। অনুবাদের শেষ দিনের আলাপে বলেছিলেন- ‘আমার মনে হয়, আমরা কন্যাসন্তানরা প্রায় প্রত্যেকেই বইটির মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাই’।
একজন অভিজ্ঞ অনুবাদক ‘রাজিয়া সুলতানা’, তিনি খুব যত্ন করে আমাকে বিবিধ ভাষার মৌলিক শব্দ ও অর্থসহ বাক্য তৈরি ও অনুবাদ করার প্রয়োজনীয় নজর-আন্দাজ এবং নৈতিকতার বিষয়ে পুরো সময়টাতে স্নেহমাখা নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। ‘নাফিসা ইসলাম’, তিনি একমাত্র বিশুদ্ধ ও বিদগ্ধ পাঠক, আমার একমাত্র বই সহপাঠী, আমরা দুইজন প্রায় একই সময়ে অ্যানি আর্নোর চারটা বই পড়েছি গত দেড় মাসে, এসব নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর আলোচনা করতাম- শব্দ, লাইন আর প্যারাগুলো তুলে এনে, আমার ফেসবুক টাইমলাইনের আড্ডায়।

‘নাইমা সেহেলী’ আমার মেন্টর, তিনি নিত্যদিন সকল প্রকারের ঠট্টোর-মট্টোর বাংলা শব্দের অর্থগুলো সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ‘শিরিন ওসমান’একজন দারুণ ফিল্ম ক্রিটিক, তিনি শুরুর দিনগুলোতে আমাকে সাহস আর উৎসাহ দিয়েছিলেন এই বইটিসহ আর্নোর বাকি বইগুলোও নিয়েও ধীরে ধীরে অনুবাদ কাজ শুরু ও শেষ করতে। ‘পারু পারভীন’ খুব মজার একটি মানুষ এবং অসাধারণ পাঠক,গল্পের বইগুলো পড়তে যে আনন্দ পাওয়া যায় এখনো, তার আগ্রহ ও প্রকাশ থেকে জেনেছি, আমার এই বইটা নিয়ে কাজের পেছনে তার বিশাল উৎসাহ ও অবদান আছে। ‘ফারহিম ভীনা’ একজন বিশুদ্ধ পাঠক, একান্তই এই অনুবাদ বইটির পূর্ণাঙ্গভাবে পাঠের অপেক্ষায় আছেন।

তেমনিভাবে আরেকজন চমৎকার পাঠক ‘আঁখি আক্তার’, তার শতবর্ষজীবী শয্যাশায়ী অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে বলা জীবনের গল্পটি আমাকে অদ্ভুত উৎসাহ দিয়েছে, এই বইটির অনুবাদ সকলের জন্য সহজ করে লিখতে। অনুবাদ বইটির টুকরো টুকরো পর্বের নিয়মিত পাঠক ছিলেন যারা- তাদের মাঝে সারাক্ষণ বা এই বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে আমার যে কোনো সময়ের ক্ষণিকের উপস্থিতিতেও নিরন্তর উৎসাহ ও পাঠপ্রেরণা দিয়েছেন যারা- সোহানা শারমিন জিপি, সামিয়া আলম, বীথি রহমান, মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, মহসীন সৈকত, প্রচ্ছদ চৌধুরী, নিও হ্যাপি চাকমা, আব্দুল আজিজ, সুলতান মাহমুদ রতন, রাসেল রহমান, মাহমুদ সানা, সানোয়ার রাসেল, লাবণী সরকার, নাজমুন নাহার, মাহিরা রুবি, জাকিয়া এস আরা, কাওসার ইসলাম তন্ময়, মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর, ক্ষমা মাহমুদ, সিরাজুল ইসলাম, লুনা রাহনুমা, লাকি আফরোজা বানু, শারমিনুন নাহার, অস্ট্রিক আর্যু, নোটন সরকার, সৈয়দ তারেক, নৈরিৎ ইমু, কাজী জাহান আরা লাবণী, নন্দিতা নাজমা, সৈয়দা ফারহানা তাইফুর, ইফফাত আরা খানম, সৈয়দ জাকির হুসাইন, সাকিবুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক রাজু, জামিলুর রহমান, লিপি খান, শাহরিয়ার সুজন, হাসিব সাইফসহ সকলের কাছে আমি ঋণী ও অধমর্ণ, তাই তাদের সকলের এই অবারিত দয়া ও প্রকাশের প্রতি ভালোবাসাসহ কৃতজ্ঞতা জানাই।

আমার মা তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে অদ্ভুত সব কা-কারখানা শুরু করেছিলেন একটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার ঠিক দুই বছর পর, ওই ঘটনাটির পরে যখন তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন; সড়কের লালবাতি চিহ্ন সংকেত অমান্য করে একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেলে দিয়েছিল। নর্মন্ডির ইউভ্যতঁ’এর বৃদ্ধপল্লীতে একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া করে কয়েক মাস একাই থাকা শুরু করলেন তিনি; কিন্তু ১৯৮৩-এর গ্রীষ্মকালের তীব্র গরমের এক দুপুরে অজ্ঞান হয়ে গেলে নিবাসের লোকেরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

জানা গেল গত কয়েকদিন খাবার বা পানীয় জাতীয় কিছুই তার খাওয়া হয়নি। তার ঘরের ফ্রিজটিতে কোনো খাবার ছিল না, ভেতরের বক্সে শুধু একটি ছোট্ট প্যাকেট পড়ে আছে, তালমিশ্রি, জমাট চিনির ছোট ছোট টুকরো। এটা পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে তিনি একা থাকার ক্ষমতা হারিয়েছেন, এভাবে তাকে আর নিজের উপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাকে আমার কাছে আসতে দেব। সেইর্জি’তে এই বাড়িতে এসে থাকবেন আমাদের সঙ্গে; আমি নিশ্চিত ছিলাম পরিচিত পরিবেশ আর আমার দুই কিশোর ছেলে এরিক আর ডেভিড, তার দুই নাতিকে শিশু অবস্থায় যতœ করে পালন করতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন তিনি; ওদের সঙ্গ ভালো লাগবে, আর এতে ধীরে ধীরে বিষণœতা কেটে গিয়ে রোগ সেরে যাবে, এবং আগের মতন উদ্যমী, স্বাধীন মহিলা হয়ে উঠবেন তিনি, যা সবসময় ছিলেন।

তিনি এলেন, কিন্তু এটিই সবকিছুর সমাধান নয়। এত চেষ্টার পরেও তার স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। ডাক্তার আলঝেইমার রোগের সম্ভাবনার কথা বলেন। তিনি আজকাল আমার সন্তানদের মতো, আমার প্রাক্তন স্বামীর মতো, আর যেসকল আত্মীয়স্বজন, অতি পরিচিত মানুষরা ছিল তার জীবনে এদের কাউকেই চিনতে পারছেন না। এমন কি স্থান আর জিনিসপত্র এসবও আর ঠাহর করতে পারছেন না।
দিনে দিনে তিনি একজন উ™£ান্ত মহিলা হয়ে ওঠেন। নার্ভাসভাবে বাড়িতে ঘোরাঘুরি করতেন। করিডরের সিড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল হয়ে বসে থাকতেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে, তার অবসাদগ্রস্ততা, ক্ষুধামন্দা ও একাবারেই কিছু খেতে অস্বীকৃতি জানানো দেখে ডাক্তার তাকে পন্তোয়্যাজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নেন। মাত্র দুই মাস সেখানে থেকেছেন। এরপর কিছুদিন একটি প্রাইভেট নার্সিং হোমে (আস ভিলেজ) থাকা শুরু করলে পরে অবস্থার অবনতি দেখে পন্তোয়্যাজেই ফিরিয়ে আনেন ডাক্তার। (বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা সংক্রান্ত বিভাগ) জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে রাখেন, হৃদস্পন্দন ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে তিনি মারা যান সেখানে, ঊনসত্তর বছর বয়েসে।
তিনি যখন আমার সঙ্গে বাস করতেন, আমি তখন ছোট ছোট টুকরো কাগজে টুকে রাখতাম- তিনি যা বলতেন, যা করতেন, তার যে জিনিসগুলো আমি খুব ভয় পেতাম। আমার মাকে এমন অসহ্য অবনতির দিকে যেতে দেখে আমি সহ্য করতে পারিনি।
একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম যে আমি রেগে তাকে চিৎকার করে বলছি ‘আপনি পাগল হওয়া বন্ধ করুন!। পরবর্তীকালে, যখন আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে আসতাম, তখন তার সম্পর্কে, এবং তিনি যে সকল কথাবার্তা আর গল্পগুলো আমাকে বলতেন; তার ত্বক ও শরীর, শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে লেখার প্রবল তাগিদ অনুভব করতাম। প্রতিদিনই ফিরে এসে কিছু না কিছু লিখে রাখতাম, যখনই তাকে দেখতে যেতাম। ওইদিনের কথাবার্তা আর স্মৃতিগুলো আমি তাড়াহুড়ো করে সংক্ষেপে টুকে রাখতাম; আমার মানসিক অশান্তি, আবেগের টালমাটাল অবস্থা, ভেতরের হুলস্থুল ভাবনা সবটাই আমি না ভেবেচিন্তে- যা আসে তাই ভাবে অগোছালো আকারে লিখে রাখতাম।

যেখানেই যেতাম, সর্বত্রই যেন আমার মায়ের ছায়া আমাকে তাড়া করে ফিরত। ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে আমি তার জীবনের গল্প লিখতে শুরু করি, অপরাধবোধ নিয়ে। আমি কল্পনায় অনুভব করার চেষ্টা করতাম যখন তিনি বেঁচে থাকবেন না সেই আমিকে, তার বাস্তবের দুনিয়াতে উপস্থিতিশূন্য আমার সেই অদেখা জীবনটাকে। আমি আমার লেখার ভেতরেই চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিলাম- সেখানে আমার মাকে একজন জবরদস্ত তরুণীর মতো সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে দেখতাম, আর বাস্তবে হাসপাতালের বৃদ্ধ মানুষটির সামনে এসে যখন দাঁড়াতাম, তার এই অবর্ণনীয় দুর্গতি আমাকে টানাপোড়েনের ভেতরে ফেলে দিত। (চলবে)

×