
আল মাহমুদ উৎসব ২০২২
সেদিন যে কথাটি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলাম, আজও সেই কথাটিই বলছি- ‘বাংলাদেশ যতোদিন বেঁচে থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ততোদিন বেঁচে থাকবেন আর বাংলা কবিতা যতোদিন বেঁচে থাকবে আল মাহমুদও ততোদিন বেঁচে থাকবেন’। না এটা শুধুমাত্র কোনো মুখে বলার কথা নয়, এটা আমার বিশ্বাস। এক সময় রাজনীতি আমার ঝুল বারান্দায় তুমুল বাতাস হয়ে দুলে গেলেও এখন আমি সেটা থেকে অনেক দূরের মানুষ। আমি কোনো রাজনীতি বুঝি না।
আমি মাটি ও মানুষ বুঝি, কবিতা বুঝি। আমি আমার দেশকে ছুঁয়ে যেতে যাই, পাখির উড়ালের সাথে বেঁধে দিতে চাই আমার উড়াল, আমার পতাকা, আমার স্বাধীনতা। আমার দেশ মানেই, পতাকা মানেইÑ বঙ্গবন্ধু আর আমার কবিতার উড়ালে আঁকা যে ক’টি নাম তার সর্বাগ্রে আল মাহমুদ। কবিতার এই প্রবল পুরুষের মৃত্যুর পর তার প্রথম জন্মদিনটিকে আমি ‘আল মাহমুদ উৎসব’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেই। এবং বৃষ্টিছোঁয়া সেদিন নগরীর কবিতা ক্যাফেতে আয়োজন করি আল মাহমুদ উৎসবের।
কবি এবং কবিতার আয়োজনে পালিত সেই উৎসবকে উপস্থিতি দিয়ে রঙিন করে তুলেছিলেন জাতিসত্তার কবি মুহম¥দ নূরুল হুদা, নির্জনতার কবি জাহিদুল হক, প্রেম ও প্রতিজ্ঞার কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ এবং মানবিক মূল্যবোধের কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। ছিলেন অসংখ্য আল মাহমুদ এবং কবিতাভক্ত মানুষ। করোনার কারণে দু’বছর ভার্চুয়ালে সীমাবদ্ধ থাকার পর এবারে আবারও প্রস্তুতি নতুন উৎসবের। কবির জন্মদিন এবং কুরবানি পাশাপশি হয়ে যাওয়ায় এবং পরপরই শোকের মাস থাকায় উৎসবটি নিয়ে আসা হয় সেপ্টেম্বরে।
তিন সেপ্টেম্বর শনিবার বাংলা কবিতা এবং আল মাহমুদ এসে জড়ো হন মহানগরীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সবচেয়ে বড়ো মিলনায়তনটিতে। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা, ঠিক বারো ঘণ্টা উচ্চারিত হন আল মাহমুদ; কবিতা এবং কথায়। উদ্বোধনী পর্বে ‘যে জলে আগুন জলে’ খ্যাত প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারই অনুরোধে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন আয়োজনের উদ্বোধক বরেণ্য কবি জাহিদুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি মাহবুব হাসান, কবি মাহমুদ কামাল এবং কবি সৌমিত বসু (ভারত)। প্রধান আলোচক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন।
আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী পর্বে বাংলাদেশ ও ভারতের তিনজন কবিকে দেয়া হয় ‘আল মাহমুদ পদক’। এবার যারা এ পদক লাভ করেছেন, তারা হচ্ছেন বাংলাদেশের কবি মাহমুদ কামাল এবং জাকির আবু জাফর আর ভারতের কবি সৌমিত বসু। পদক প্রাপ্তির পর কবি মাহমুদ কামাল বলেন, ঘোষণার প্রথম বছরেই এ পদক লাভ নিঃসন্দেহে একটি বিশাল বিষয়। একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বাকি দুজনও।
কবিতা অধিবেশনের শুরুতেই প্রথম অধিবেশনের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ যখন একটি আল মাহমুদ চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এই উৎসব এবং পদক প্রদান বিষয়টির ধারাবাহিকতা রক্ষার আহবান জানান, তখন হলভর্তি কবিদের তুমুল করতালি তার প্রস্তাবের পক্ষে সকলের সমর্থনকেই ঘোষণা করে।
আল মাহমুদ বলতেন, কবিতা কষ্টের কলা। সেই উচ্চারণের প্রতিধ্বনি যেন ফুটে ওঠে কবিতাপাঠ পর্বের অধিবেশনগুলোতে দায়িত্ব নেয়া সভাপতি ও প্রধান অতিথিদের কণ্ঠেও।
কবিতা দিয়ে আল মাহমুদ উৎসব এবং সম্প্রীতির কবিতাপাঠকে যারা উদ্দীপ্ত করে তোলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতের কবি সৌগত প্রধান, দেবাশীষ মল্লিক, ইন্দ্রানী দত্ত পান্না, সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য, রাখহরি পাল, অংশুমান চক্রবর্তী, সন্দীপ সাহু, বিমল মন্ডল, বিপ্লব চক্রবর্তী, শুভঙ্কর দাশ, গার্গী সেনগুপ্ত, নূপুর মুখার্জি, সর্বানী ঘড়াই, পারুল কর্মকার, স্মিতা চক্রবর্তী, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
আর বাংলাদেশী কবিদের মধ্যে আবদুল বাতেন, হাসান মাহমুদ, শামীমা চৌধুরী, নাহিদা আশরাফী, তাহমিনা কোরাইশী, তৌফিক জহুর, নুর কামরুন্নাহার, ফাতিমা তামান্না, জায়েদ হোসাইন লাকী, ফরিদ ভূইয়া, ফারুক আফিনদী, রফিক হাসান, শাহীন চৌধুরী, গাজী গিয়াসউদ্দিন, পারভীন শাহনাজ, জাহানারা বুলা, মুহম্মদ আশরাফুল ইসলাম, মুশতাক মুকুল, জামিল জাহাঙ্গীর, রমজান বিন মোজাম্মেল, শিমুল আজাদ, মোজাফ্ফর বাবু, চন্দন কৃষ্ণ পাল, কবিতা কস্তা, তাহমিনা শিল্পী, সৌমিত্র দেব, জোহরা আকতার, শামীম আরা, তিথি আফরোজ, জেবুননেসা হেলেন, শেলী সেলিনা, অসীম কুমার ঘোষ, রনি অধিকারী, মাহবুব শওকত, জান্নাত তায়েবা, মাশরুরা লাকী, আবদুর রাজ্জাক, শিউলী সিরাজ, মিজান ফারাবী, বাবলী খান, অনন্ত রিয়াজ, গোলাম রব্বানী টুপুল, রাজিয়া সুলতানা, এজাজ সানোয়ার, জিয়া হক, শাহিদা ইসলাম, কুসুম তাহেরা, নিলুফা জামান, শ্যামলী খান, রফিক লিটন, কামরুজ্জামান কায়েম, আলম শামস, আশরাফ মির্জা, তারেক মাহমুদ, মনিরুজ্জামান পলাশ, মাহফুজ রিপন, ক্যাথরিনা হীরা, স্নিগ্ধা নীলিমা, সালামুজ্জামান, হাবিবা খানম প্রমুখ। দুই দেশের ২৩৪ কবির মিলিত কোরাসে আল মাহমুদ, কবিতা এবং সম্প্রীতি যেন ধ্বনিময় হয়ে ওঠে, হয়ে যায় একাকার।
প্রধান অতিথি জাহিদুল হক যখন বলেন, আল মাহমুদ বাংলা কবিতার প্রকৃত শক্তির আধার কিংবা ভারতের কবি ইন্দ্রজীৎ ভট্টাচার্য অথবা সুনীল মাজি যখন আল মাহমুদকে ছেড়ে দেন কবিত্বের শ্রেষ্ঠতম আসন, তখন গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে বৈকি।
আল মাহমুদ ভেসে বেড়াতে থাকেন মাইক্রোফোনে, অডিটরিয়ামে এবং প্রতিটি হৃদয়ে। কামরুল হাসানের নোটবুক এবং ক্যামেরার ফ্লাশ যত ভারী হতে থাকে ততটাই আমরা এগিয়ে যেতে থাকি একটি নতুন ইতিহাসের দিকে।
সমগ্র আয়োজনটি গীতিময় হয়ে ওঠে একঝাঁক তরুণের নিবিড় প্রচেষ্টায়। সঞ্চালনায় কবি কামরুজ্জামানের সরব উপস্থিতি, পরিকল্পনা ও বিন্যাসে কবি পলি রহমানের ঐকান্তিক মমত্ব আর তার পাশে তরুণ কবি পথিক সবুজ, নুরুল আবছার এবং সাঈদ তপুর দৃৃঢ় উপস্থিতি একে করে তোলে অর্থবহ ও সার্থক।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের পথ ধরে বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ একটি উজ্জ্বলতর অধ্যায়। আড়াল হয়ে থাকা প্রবল মানুষটিকে নিয়ে একটি উৎসব নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি বিষয়। তবু আমরা ভারত থেকে উড়ে আসা ২২ জন কবিসহ এদেশের ২৩৪ জন কবি তাকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতাকে আরেকবার স্পর্শের প্রচেষ্টা চালালাম। আমরা কতটুকু তাতে সফল তা বলে দেবে মহাকাল।