
ভারত বিভাগ ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম
সুসাহিত্যিক এবং মানবতাবাদী কবি ও গীতিকার সাবির আহমেদ চৌধুরীর বয়স এখন ৯৮ পেরিয়ে গেছে। তাঁর জন্ম ১৯২৪ সালে। এ সময় ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছে যেখানে যুবা বয়সে তিনি এগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবিভাগ হয়ে মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান এবং হিন্দুদের জন্য ভারত সৃষ্টি হয়। এ আন্দোলনও দেখেছেন এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
এমনকি পরবর্তীতে বাংলা ভাষা রক্ষা আন্দোলনেও অংশ নেন এবং তার জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের একটি চাকরি থেকে তাঁকে বাদ দেয়া হয়। দুই বছর পরে তিনি আবারও সে চাকরিতে বহাল হওয়ার আদেশ পান। এর পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ইতিহাস আর ভারতে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে যে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়, তার সর্বশেষ ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
তাঁর তথ্যপূর্ণ এ বইয়ে একস্থানে উল্লেখ করেন, ‘আল্লাহ যেমন মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তেমনই মানুষের ভাব প্রকাশ করার জন্য ভাষাও আল্লাহর সৃষ্টি।’ (সূরা : ইব্রাহিম, আয়াত : ৪)। এ নিয়ে কারও কারও বিতর্ক থাকতে পারে। তবে লেখক এ বরাবরই বলেছেন, তাঁর উপলব্ধি এবং দেখা বিষয়গুলোরই সন্নিবেশ এ বইতে যেখানে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন।
মুসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ হয় হিব্রু ভাষায়, দাউদ (আ.)-এর ওপর যবুর অবতীর্ণ হয় ইউনানি ভাষায়, ইসা (আ.)-এর ওপর ইনজিল অবতীর্ণ হয় সুরিয়ানি ভাষায়, মোহাম্মদ (সা.আ.)-এর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয় আরবী ভাষায়।
এমন ধরনের আরও কিছু দুষ্প্রাপ্য তথ্য রয়েছে এ বইতে। তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে দীর্ঘদিন ভারত মুসলমানদের শাসনাধীনে থাকলেও ভারতীয় হিন্দুরা এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসন চায়নি। এ কারণে তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভারতবর্ষ স্বাধীন করে নিজদের শাসনাধীনে রাখতে চেয়েছিল। এক সময় গান্ধীও জিন্নাহকে বলেছিল, জিন্নাহ তুমি ভারত ভাগ করও না। কাজী নজরুলও স্বরাজ দলের অনুসারী ছিলেন। ‘তিনি ১৯২৬ সালে স্বরাজ দলের প্রার্থী হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিষদে ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত আসন থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।’ (পৃ-৮১)।
১৯৪৭ সালের ২৭ নবেম্বর করাচীতে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রীদের সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে চালু করার সিদ্ধান্ত হলে তার বিরুদ্ধে ‘বাঙালীরা, বিশেষ করে আমরা ছাত্রসমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠি’ (পৃ-১১২)। এভাবে বাংলা ভাষার পক্ষের সমগ্র সংগ্রামের চাক্ষুষ ইতিহাস লিখেছেন। এ ইতিহাস আমাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়ে তার সম্পৃক্ততা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে গেলে তিনি একসময় চাকরিচ্যুত হন।
সাবির আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে হয়ত অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেননি কিন্তু, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি যেভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তা পাকিস্তানীরা জানতে পারলে বা বুঝতে পারলে হয়ত তাঁকে সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলত। এ সময় সাবির আহমেদ চৌধুরী সরকারের অধীনে নিজস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সরকারের বিভিন্ন বড় বড় স্থাপনার কাজ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ঢাকাতেই ছিলেন কারণ, তিনি জানতেন যশোর ক্যান্টনমেন্টে তার কিছু অসমাপ্ত কাজ রয়েছে।
তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় রয়েছে, এ অবস্থায় তিনি অন্যত্র গেলে পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি হতে পারে। তাঁর ধরণাই ঠিক ছিল। ১৯৭১ সালের জুন মাসেই তাঁকে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট মিলিটারি হাসপাতাল এবং ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়নের কাজ চুক্তি অনুসারে বুঝিয়ে দেয়ার কথা। তিনি সেসময়ের সেনাবাহিনীর ডাকে যশোর যান। ক্যান্টমেন্টে বিশেষ প্রহরাধীন অবস্থায় কাজ করতে থাকেন। এ সময় তিনি কিছু মানুষকে পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সে এলাকার লে-আইট নকশা সরবরাহ করেন মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে আক্রমণের জন্য। এত বড় ঝুঁকি নেয়া খুবই কঠিন কাজ ছিল, কিন্তু তিনি তা করতে পিছিয়ে আসেননি।
তিনি এ সময়ের দৃষ্টিপাত নিয়ে এভাবে লেখেন, ‘জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র দিয়ে, অন্ন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, সাহস দিয়ে যে সহযোগিতা করেছেন তার তুলনা নেই। স্বাধীনতার জন্য জনগণের এ নিঃস্বার্থ সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে।’ (পৃ-২৪৩)। তিনি তাঁর এ ইতিহাসে বাংলাদেশ টেলিভিশনের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসও তুলে ধরেছেন।
৯৮ বছরের প্রবীণ কবি ও গীতিকার সাবির আহমেদ চৌধুরীর লেখা ৩৭৬ পৃষ্ঠার এ ইতিহাসভিত্তিক বইটি কলের পুরাণে একটি মূল্যবান সংযোজন। নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি যা লিখে গেলেন, ভবিষ্যতে এ বইটিই হবে এ উপ-মহাদেশে একখণ্ড কালের পুরাণ।
ভারত বিভাগ ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম/সাবির আহমেদ চৌধুরী প্রকাশক/ডমিনো স্পর্শ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা প্রচ্ছদ/সমর মজুমদার প্রকাশকাল/এপ্রিল, ২০২২ মূল্য/৫০০ টাকা