
শওকত ওসমান। নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই ভাবনায় আসে প্রগতীশীল কথাসাহিত্যিকের অবয়ব। যার প্রথম প্রকাশিত বই শিশুসাহিত্যের অথচ লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণশীল একজন শিল্পী। তাঁর উপন্যাস ছোটগল্প নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও শিশুসাহিত্যে আলোচনা-সমালোচনা তেমন একটা নেই। কথাসাহিত্যিক উপাধির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে তাঁর অন্য সব পরিচয়। হয়ত এ কারণেই। অথচ শিশু-কিশোর সাহিত্যে তার মুন্সিয়ানা চোখে পড়ার মতো।
শিশুসাহিত্য রচনার একটা বড় বিষয় হলো শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারা। তাদের পাঠ উপযোগী করে কাহিনী রচনা করা জটিল একটি কাজ। সেই কাজটিই সাবলীলভাবে করেছেন শওকত ওসমান। তার গল্পের বিষয় বৈচিত্র্য অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, কৌতুহলী দৃষ্টিভঙ্গি, বয়ানের ধরন গল্পগুলোকে করেছে শীল্পমানসম্পন্ন। প্রথম গ্রন্থ ওটেন সাহেবের বাংলোতে যে চারটা গল্প আছে তার দুটি ভূতের গল্প, একটি ভাল্লুকের সঙ্গে ছোট মেয়ের অন্যটি কুকুরের সঙ্গে বালকের বন্ধুত্বের গল্প। গল্পের ধারাক্রমেই বোঝা যায় শিশুমনস্তত্ত্ব¡কে তিনি কিভাবে উপলব্ধি করতেন। আবার ওটেন সাহেবের বাংলো গল্পে ভূতের ভয় দেখিয়ে ব্রিটিশ সাহেবকে তাড়ানোর যে কাহিনী চিত্রায়ন করেছেন, তাতে শিশুমনে ব্রিটিশবিরোধি বিপ্লবী বীজ বপন করে দেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তৈরি হয় নৈতিক মনোবৃত্তি। কথাসাহিত্যের মতো শিশুসাহিত্যেও তাঁর প্রধান উপজীব্য বিষয় ছিল যুক্তি, বিজ্ঞান, বাস্তববাদিতা এবং সমাজের নানা বৈষম্য। এসব বিষয়কে তিনি শিশু-কিশোর উপযোগী করেছেন কমেডি এবং স্যাটায়ারের সমন্বয়ে। তাঁর পাহাড়তলীর ভূত, আবিষ্কার গল্পে কিংবা মাসফোন উপন্যাসে বিজ্ঞানের প্রাধান্য দেখা যায়। অন্যদিকে প্রাইজ, ইতা কিংবা পার্ক গল্পে তুলে ধরেছেন সমাজের নানা বৈষম্য। এ ছাড়া তার সকল রচনাতেই ইতিহাস বা সময়কে ধারণ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যা কিনা ইতিহাস সন্দিৎসু এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি সচেতন মনেবৃত্তি তৈরিতে সহায়ক।
তেমনি কিশোর উপন্যাসেও তার সহজাত ণৈপুন্য স্পষ্ট। মোট পাঁচটি কিশোর উপন্যাস। যেখানে বিষয় ও শিল্প-প্রকরণ স্পষ্টতই বৈচিত্র্যময়। ঐতিহাসিক ঘটনার বিবৃতি, আন্দোলন সংগ্রাম, বিরোধপূর্ণ সমাজ, শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং মানবিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। কাহিনীর শুরু থেকে ঘটনাপ্রবাহের সাবলীল বর্ণনা এবং পরীনতির স্বতঃস্ফূর্ততা তার রচণার অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রতিকী ব্যঞ্জনা তৈরি করে সমাজের নানা দিকগুলো যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি কিশোর পাঠকদের জন্য করেছেন উপভোগ্য। বার্তা দিয়েছেন সমাজ সংস্কারের। আবার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশুসাহিত্য রচনায় তিনি ছিলেন অগ্রবর্তী পুরুষ। তাঁর রচিত পঞ্চসঙ্গী ’৬৯-এর গণঅভু্যুত্থান এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাঁচজন বন্ধুর অংশগ্রহণ এবং তাদের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত। তাদের পরিণতি এবং নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থার দিকটি তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। তার অন্য মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে রচিত উপন্যাস মুজীবনগরের সাবু। এক কিশোরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধ পরবর্তী কিশোরের স্বপ্নের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রীক চিন্তাধারাকে লেখক তুলে ধরেছেন।
বিরোধপূর্ণ সমাজ, শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং মানবিক বিষয়গুলো লেখক তুলে ধরেছেন তার মাসফোন উপন্যাসে। শুরুতে মশাদের কথা শোনার যন্ত্র আবিষ্কার করার মাধ্যমে একটা বিজ্ঞানমনস্ক বিষয় উপস্থাপন করলেও মূলত ধর্মীয় বিদ্বেষকে উপজীব্য করেই এগিয়েছে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ। এখানে উপন্যাসিক একটি অভিনব উপায় অবলম্বন করেছেন। যেখানে মশারা কথা বলে। রূপকধর্মী এই উপন্যাসে পাঠক দারুণ থ্রিল অনুভব করার সুযোগ পায়। অন্যদিকে জুজুগগা উপন্যাসটি সায়েন্সফিকশন আকারেই নির্মিত। দুই বন্ধু’ উপন্যাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং তখন দুই কিশোরের গল্প নিয়ে এগিয়েছে। তার উপন্যাসে আখ্যানভাগ ও চরিত্রের বিস্তার দৃশ্যমান। পরিবেশের বর্ণনা, রূপরেখা, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে কাহিনীকে সুন্দর ও সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে দেখা যায়। ফলে তার উপন্যাসগুলোকে সার্থক কিশোর উপন্যাস বলা চলে।
আগেই বলেছি তার অন্য পরিচয় আড়াল হয়ে গেছে কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের আড়ালে। তেমনি তার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো নাট্যকার শওকত ওসমান। নাটকে তার বিশিষ্টতা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তার আমলার মামলা, কাঁকর-মণি, তস্কর-লস্কর, জন্ম-জন্মান্তর নাটকগুলো ঐতিহাসিক ও নাট্য সাহিত্যের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। শিশু-কিশোর উপযোগী তার চারটি নাটক আছে। তার প্রথম শিশুতোষ নাটক ‘এতিমখানা’। এটি মূলত তার কিশোর উপন্যাস ‘তারা দুইজন’ এর নাট্যরূপ। দুই অঙ্কবিশিষ্ট এই নাটকে পাঁচটি দৃশ্য আছে। এ ছাড়া তিনটি ছোট একাঙ্কিকা নাটক। যেগুলো বিদেশী রূপকথা, গল্প ও নাটক অবলম্বনে রচিত। বিদ্যার বাহাদুরী ও রাখাল বাদশা কাব্য নাটক। কারুর মোরগ নাটকটি গদ্যে লেখা। রাখাল বাদশা নাট বিদ্যমান। তার শিশুতোষ নাটকগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এ জন্য যে, শিল্পমানে এবং শিশুদের নাট্যচর্চায় এগুলো অত্যন্ত উপযোগী। নাট্যচর্চায় উৎসাহ প্রদান এবং ভীত রচনায়ও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যেমন ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’র মতো ঘুম পাড়ানি গানে করুণ ইতিহাস বলে বাচ্চাদের ঘুম পড়াই। যেখানে বর্গীদের অত্যাচারের কথা, খাজনার ইতিহাস বলা হয়। তেমনি শওকত ওসমান এর শিশু-কিশোর সাহিত্যেও সমাজচিত্র, ইতিহাস, যাপিত জীবনের নানা অসঙ্গতি এবং সংস্কারের কথা ব্যক্ত হয়েছে। লেখক চেষ্টা করেছেন আগামী প্রজন্মকে বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক ও যুক্তিবাদী করে তোলার। সেই বিবেচনায় শওকত ওসমান একজন সফল শিশুসাহিত্যিক। কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের পাশাপাশি শিশুসাহিত্যিক পরিচয়টিও তার নামের পাশে যথার্থতার দাবিদার। দুই খ-ে প্রকাশিত কিশোর সমগ্রটি এই দাবির পক্ষে দাঁড়ায়।