
মহাশ্বেতী দেবী বাংলা সাহিত্যের একজন স্বতন্ত্র ধারার লেখক। গণমানুষের কণ্ঠস্বর। তার সৃষ্ট গল্প, উপন্যাস জুড়ে স্বাতন্ত্র্যের এ ছাপ সুস্পষ্ট। বাংলা কথা সাহিত্যে তার ভিন্নধর্মী অবস্থান তাকে সমকাল, মহাকাল সমর্থন ও সম্মান দিয়ে অভিনন্দিত করেছে। তার লেখার বিষয়, ভাষাশৈলী, উপস্থাপন তার জীবন, অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের নিবিড় প্রকাশ।
তিনি ঘরে বসে কল্পনার আকরে কোন কিছু রচনা করেননি। যা দেখেছেন, আহরণ করেছেন তার আলোকে গল্প, উপন্যাস লিখেছেন। তার গল্প, উপন্যাসের কাহিনী পটভূমি, চরিত্র তার চেনা-জানা, দেখার ভুবন থেকে আহরিত। তিনি ছুটি গেছেন সেই সব মানুষের কাছে যাদের জীবন সামাজিক কষাঘাতে জর্জরিত, অধিকার ও মর্যাদাহীনতার অন্ধকারে নিপতিত। তাইতো তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ছত্রিশগড় রাজ্যের আদিবাসীদের জীবন দেখতে ছুটে গেছেন তাদের মাঝে। দেখেছেন, আহরণ করেছেন লেখার উপাদান। প্রত্যক্ষ করেছেন নির্মম বাস্তবতা।
মহাশ্বেতা দেবীর জীবন ও লেখক সত্তায় তার লালিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিবাদী মনন, প্রগতিশীলতা, সাধারণ মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, সামাজিক দায়বোধ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তার সাহিত্য মানস সময়ের জাড়িত পরিবেশ ও পরিস্থিতির দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত। তিনি অনেকের মতো তা উপেক্ষা করতে পারতেন। ঘরে বসে লিখতে পারতেন অনবদ্য অনেক কিছু। কিন্তু সামাজিক দায়, মানুষের বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই, অসাম্য, অনাচার, রাষ্ট্রীয় বিমুখতা তাকে স্বতন্ত্র ধারায় লিখতে প্রচণ্ডভাবে তাড়িত করেছে। এ তাড়া তার অন্তর্গত বোধ, মানবিক দৃষ্টিকে করেছে প্রসারিত। প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভেদ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি লেখনিকে মানবিক হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নিজস্ব জীবনবোধ ও লেখক সত্তা এক অভিন্ন আলোকে প্রজ্বলিত শিখায় জ্বলে ওঠেছে। তাই তার লেখা যেমন হয়েছে মানবিক উপাখ্যান, তেমনি সময় ও কালের ইতিহাস। সমাজ বাস্তবতা ও পর্যবেক্ষণের অনবদ্য চিত্র।
মহাশ্বেতা দেবীর সর্বাধিক আলোচিত, সমাদৃত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, হাজার চুরাশির মা, অরণ্যের অধিকার। তবে আদিবাসী মানুষের জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু’ নানা কারণে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে তার যে লেখালেখি, নিরন্তর সংগ্রাম এ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তার শুরু। তবে ভাষাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিষয়গত বিস্তৃতির জন্য’ আঁধার মানিক, অমৃতসঞ্চয়, বিবেক বিদায় পালা, চোট্টিমুন্ডা এবং তার স্ত্রী, অগ্নিগর্ভা তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
‘হাজার চুরাশির মা’ মহাশ্বেতা দেবীর এক অনন্য সৃষ্টি। এ উপন্যাসটিকে লেখক মহাশ্বেতা দেবীর বাঁক পরিবর্তনের সূচনা পর্ব বলে অনেকে মনে করেন। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর ব্রতী ও তার বন্ধুদের আত্মোৎসর্গের এক মর্মস্পর্শী কাহিনী। সত্তর দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাসটি রচিত। সন্তানহারা মা সুজাতার অন্তর্দহনের এক অতলস্পর্শী আলেখ্য। এখানে তিনি প্রচলিত রাজনীতির অন্ধকার দিকসমূহ উন্মোচনের প্রয়াশ চালিয়েছেন। হাজার চুরাশির মা উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী এক অস্থির রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি ও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কাহিনী তুলে ধরেছেন অসাধারণ দক্ষতা ও সহমর্মিতায়।’ অরণ্যের অধিকার’ তার আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। অধিকারহীন আদিবাসী মুন্ডা জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের আলেখ্য এ উপন্যাস। জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি আদিবাসীদের মাঝে কাটিয়েছেন। তাদের নিয়ে লিখছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি আদিবাসীদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি গল্প, উপন্যাস রচনা করেন।
শতাধিক উপন্যাসের পাশাপাশি গল্পগ্রন্থ রয়েছে তার বিশটির মতো। তার গল্পসমূহে আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিগৃহীত জীবন, শাসক গোষ্ঠীর অব্যাহত নির্যাতন, বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম তুলে ধরেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থসমূহ হলো: শালগিরার ডাকে, হরিরাম মাহাতা, ইটের ওর ইট, সিধুকানুর ডাক প্রভৃতি। তার শিশুতোষ গল্পের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম ১৪ জানুয়ারি ১৯২৬, মৃত্যু ১৬ জুলাই ২০১৬। কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী হিসেবে তিনি পরিচিত। এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা কল্লোল যুগের বিশিষ্ট লেখক মনীশ ঘটক। মা ধরিত্রী দেবী কবি। চাচা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চিত্র পরিচালক ঋতিক কুমার ঘটক। স্বামী নাট্য ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য ও ছেলে নবারুণ ভট্টাচার্য। নবারণ ভট্টাচার্যও ঘনিষ্ঠভাবে লেখালেখি করতেন। এমনি এক সাংস্কৃতিক পরিবার তার। তবে লেখাকে বেছে নিয়েছিলেন জীবনের চরম ব্রত হিসাবে। এ জন্য শেষ পর্যন্ত সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাহিত্যের প্রতি একাগ্রতার প্রয়োজনে বেছে নিয়েছিলেন নিভৃত জীবন। তিনি শুধু লেখক হওয়ার জন্য লিখেননি। লিখেছেন সামাজিক দায়, মানুষের মুক্তি ও মানবিকতার প্রতি প্রগাঢ় বোধ ও অপরিসীম মমত্ববোধের তাগিদে।
সাহিত্যে তার অবিস্মরণীয় অবদানের নানা সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ ও ব্রাহ্মণ ম্যাগসাইসাইসহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার। ভারত সরকার পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণে ভূষিত করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভূষিত করেন সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণে’।
মহাশ্বেতা দেবীর সৃষ্ট সাহিত্য সমাজ বাস্তবতা, মানব মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষার দলিল। জীবন সংগ্রাম ও মানবিক দহন ও গণমানুষের জীবনের অনবদ্য চিত্র। কালো অক্ষরে লেখা কালের উপাখ্যান। মানবিক কাব্য।