
ছবি: সংগৃহীত।
দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকটে নাজেহাল হয়ে পড়েছে বাসাবাড়ি, কলকারখানা ও পরিবহন খাত। সিএনজি স্টেশনগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে গাড়িচালকদের। অন্যদিকে, গৃহিণীদের অভিযোগ—সকালে রান্না শুরু করলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত চুলায় আগুন আসে না। শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে রপ্তানি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ভুল পরিকল্পনা ও অবহেলার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা যেখানে প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে সরবরাহ হচ্ছে তার চেয়েও কম, মাত্র ৩০০০ মিলিয়ন ঘনফুটেরও নিচে।
রাজধানীর বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনে গভীর রাতেও গ্যাসের জন্য অপেক্ষা করছেন চালকরা। কিন্তু লাইনে পৌঁছানোর পরও মিলছে না পর্যাপ্ত চাপ। একজন চালক বলেন, “গ্যাস ঢুকে ৮০-১০০ টাকার বেশি না। দুই-তিনবার চেষ্টা করার পরেও মেলে না। অথচ লাইন দিতে হয়েছে দু’ঘণ্টা।”
বিভিন্ন এলাকায় সকাল ছয়টা থেকে রাত পর্যন্ত গ্যাস না থাকায় রান্না করতে পারছেন না গৃহিণীরা। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে বৈদ্যুতিক রাইস কুকার বা এলপিজি সিলিন্ডারের দিকে ঝুঁকছেন, যা ব্যয়বহুল।
গ্যাস সংকটের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পকারখানা। অনেক গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বিদেশি অর্ডার সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারছে না উদ্যোক্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৪ সালের পর থেকেই সরকার ‘দেশে গ্যাস নেই’ এমন ধারণা ছড়িয়ে আমদানিকেই প্রাধান্য দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬-১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি, ভারতের পেট্রোনেট ও সামিট গ্রুপের সঙ্গে এলএনজি আমদানির চুক্তি করে সরকার।
কিন্তু এসব আমদানিনির্ভর পদক্ষেপের ফলে উপেক্ষিত হয় দেশীয় অনুসন্ধান ও উত্তোলন। ২০১৭ সালে পাবনার মোবারকপুর গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়, এরপর প্রায় বন্ধ হয়ে যায় অনুসন্ধান কার্যক্রম। ফলে কমতে থাকে গ্যাসের মজুদ।
ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ এবং মিয়ানমারের সু গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রতিবেশীরা সফলভাবে গ্যাস উত্তোলন করছে। মিয়ানমার তো এই গ্যাস থেকেই নিজ দেশের এক-তৃতীয়াংশ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি চীন ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি করছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখনো বঙ্গোপসাগরের ব্লক এসএস-১১ ও ডিএস-১২ এর সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্রগুলো কাজে লাগাতে পারেনি। কেবল দরপত্র আহ্বানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে কার্যক্রম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের বদ্বীপ অঞ্চলে বিপুল গ্যাস ও তেলের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা এখনো যথাযথভাবে অনুসন্ধান করা হয়নি। স্থলভাগের মাত্র ১০ শতাংশে অনুসন্ধান হয়েছে, বাকি ৯০ শতাংশ এখনো অনাবিষ্কৃত।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, দেশীয় উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ালে জ্বালানি খাত আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। স্থায়ী সমাধান পেতে হলে এখনই সমন্বিত জ্বালানি ব্যবস্থাপনা ও স্বনির্ভর অনুসন্ধান কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
এদিকে, সরকারের তরফে বারবার সংকট সমাধানের আশ্বাস মিললেও বাস্তবে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে—আর এর মাশুল গুনছে পুরো অর্থনীতি।
নুসরাত