ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মূল ফোকাস নির্বাচন

প্রধান উপদেষ্টাকে বার্তা দেবেন খালেদা জিয়া

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২৭ মে ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টাকে বার্তা দেবেন খালেদা জিয়া

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বার্তা দেবেন বেগম খালেদা জিয়া

দেশকে সংকটমুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বার্তা দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এতে প্রধান ফোকাস থাকবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানাবেন। থাকবে জাতীয় ঐক্যের ডাক। এ বার্তায় উপদেষ্টাদের কম কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। 
খালেদা জিয়ার লিখিত বার্তায় দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা ছাড়াও থাকবে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হুমকি থেকে দেশকে রক্ষা করা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য দ্রুত একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করা। আর কোনো অবস্থাতেই যেন অন্তর্বর্তী সরকার বিফল না হয় সে জন্য ড. ইউনূসের প্রতি থাকবে বিশেষ পরামর্শ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়া প্রধান উপদেষ্টাকে বার্তা দেবেন কি না এখন কিছু বলতে চাই না। অপেক্ষা করেন, যথাসময়ে সবকিছু জানতে পারবেন ইন শা-আল্লাহ। সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার বার্তার একটি ড্রাফট তৈরির কাজ চলছে। বিএনপির ক’জন সিনিয়র নেতা, সাবেক আমলা ও বুদ্ধিজীবী এই ড্রাফট তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে এই ড্রাফট তৈরির কাজ অতি গোপনে করা হচ্ছে। দলের সংশ্লিষ্ট ক’জন নেতা ছাড়া আর কেউ বিষয়টি জানেন না। এটি তৈরির কাজ শেষ হলে খালেদা জিয়ার কাছে দেওয়া হবে।

তিনি যদি ড্রাফটে থাকা বার্তায় কিছু বিষয় সংযোজন বা বিয়োজন করতে চান তা করার পর এটি চূড়ান্ত করা হবে। ড্রাফটি চূড়ান্ত হওয়ার পর যে কোনো দিন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তা পৌঁছে দেওয়া হবে। কাউকে পাঠিয়ে হোক আর যে কোনোভাবেই হোক লিখিত বার্তাটি ড. ইউনূসের কাছে পাঠাবেন খালেদা জিয়া। তবে তার আগে এ বিষয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা হতে পারে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও প্রবীণ জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ও দুইবার জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। এ ছাড়া নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন সংগামে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সফল হয়েছেন। খালেদা জিয়া তার কর্মকা-ের মাধ্যমে দেশের সিংহভাগ মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশ-বিদেশে সর্বত্র তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। 
এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদ, সেনাবাহিনী, আমলাসহ সরকারি-বেসরকারি সিনিয়র পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা খালেদা জিয়াকে অত্যন্ত সম্মান করেন। তাই দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশকে সংকটমুক্ত রাখতে বার্তা দিলে আর সে বার্তা সরকার অনুসরণ করলে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তা ব্যাপক সাড়া ফেলবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। 
সার্বিক বিবেচনায় খালেদা জিয়ার এই বার্তা থেকে সরকার যেমন অনুপ্রেরণা পাবে তেমন রাজনৈতিক দলসহ সর্বস্তরের মানুষ একটি সময়োপযোগী দিক নির্দেশনা পাবে। এর ফলে একদিকে যেমন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ করতে সুবিধা হবে, অপরদিকে দেশের মানুষও সরকারকে সহযোগিতা করতে বেশি আগ্রহী হবে।
জাতীয়তাবাদী শিক্ষক নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান খান জনকণ্ঠকে জানান, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা  জিয়া চাইলে সরকারপ্রধানকে একটি বার্তা দিতে পারেন। কারণ, দেশের যে কোনো জাতীয় সংকটে সবসময়ই তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাই যদি পরিস্থিতি আরও জটিল হয় তাহলে তিনি অতীতে যেভাবে দেশের স্বার্থে ভূমিকা রেখেছেন এবারও সেভাবে ভূমিকা পালন করবেন। তিনি তার অবস্থান থেকে যখন যা করণীয় তাই করবেন। 
সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টাকে বার্তা দেওয়ার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বার্তার ড্রাফটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে। দ্রুত নির্বাচন করে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনর পরামর্শ থাকবে। এতে আরও থাকবে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়ার বার্তা। আর নির্বাচিত সে সরকার হবে জাতীয় সরকার। অর্থাৎ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেন সরকার গঠন করা যায় সেরকম সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। 
বার্তায় আরও উল্লেখ করা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করা করতে হবে। এই রূপরেখা অনুসারে নির্বাচন ও প্রশাসনসহ কিছু জরুরি বিষয়ে দ্রুত সংস্কার করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন হবে এবং এই সরকার রূপরেখায় থাকা অন্য সংস্কারগুলো ধারাবাহিকভাবে করবে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়নে নির্বাচিত সরকারকে একটি গাইডলাইন দিয়ে যাবে। 
খালেদা জিয়ার বার্তায় আরেকটি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা হচ্ছে সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিতর্কিত না করা। আর বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া। 
বার্তায় উল্লেখ থাকছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংবিধান সংশোধন করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করা। 
খালেদা জিয়ার বার্তায় আরও উল্লেখ থাকছে, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া। বিদেশে শ্রমবাজার প্রসার করে রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়ানো এবং তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিবৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করা। এ ছাড়া বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করা, শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়ন ও চাকরি ক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন। পররাষ্ট্র নীতির আলোকে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখা এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। অতীতের সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা। আর জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন না করা। 
এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান ইতিবাচক থাকলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্যই সফল হবে এবং এ বিষয়ে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলেও খালেদা জিয়া তার বার্তায় উল্লেখ করছেন। তবে সরকারের উপদেষ্টাদের কম কথা বলার পরামর্শও থাকবে এ বার্তায়। 
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মনে করি ডিসেম্বরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া দরকার। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকেও আমরা তা জানিয়ে এসেছি। প্রয়োজন হলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধান উপদেষ্টাকে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে বার্তা দিতে পারেন। তবে এখনো আমরা এ বিষয়ে চিন্তা করিনি।
উল্লেখ্য, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে দেশের চলমান সংকট নিরসন করতে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ধারাবাহিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা করছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বেশ ক’দফা বৈঠকেও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলে এসছেন সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া অতিসম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীসহ দেশের ৬২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি আদায় করতে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

আর যারা টেলিভিশনে টকশো করেন তাদেরকে বলেছেন, ডিসেম্বরে নির্বাচনের যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধান উপদেষ্টাকে লিখিত বার্তা দিলে তা দেশকে সংকটমুক্ত রাখতে ব্যাপক কাজে আসবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

আরো পড়ুন  

×