
বাংলাদেশ সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি কত দুর্বিপাক, লাঞ্ছনা, যন্ত্রণাকে মেনে নেওয়াও যেন পরিবেশের নির্মমতা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনও তৈরি হচ্ছে গৃহকর্মী কিশোরী, তরুণীদের নিত্য ঘানি টানা জীবন নিয়ে। সুরাহার পথ নির্দেশিত সেভাবে হয় না। বরং নির্বিচার-অত্যাচার আর নির্মমতার দুঃসহ কাহিনী গণমাধ্যমের পাতা ভারি করে। সমাধানের উপায় আজও দূর অস্ত। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত আর ধনী পরিবারে গৃহকর্মী রাখার চিত্র দৃশ্যমান। আলোচনা করছি নারী গৃহকর্মীদের নিয়ে। যারা মূলত কিশোরী, উদীয়মান তরুণী থেকে যুবতী এমনকি মধ্য বয়স্ক নারীও যুক্ত থাকেন এমন গৃহকর্মের কাজের জায়গায়। শখ করে নয় কিন্তু। জীবন আর জীবিকার তাড়নায় তাদের অন্যের বাড়িতে শ্রম বিনিয়োগ করে দিন অতিবাহিত করতে হয়। বিষয়টা মোটেও স্বস্তিকর নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি হয় আরও নির্মম আর বেদনাদায়ক। সম্পন্ন গৃহস্থরাই সাহায্যকারী হিসেবে কাউকে না কাউকে বাসায় রাখতে পারেন। প্রচলিত নিয়মনীতিতে কাজকর্মের বিষয়ও নির্ধারণ করা থাকে। উন্নত প্রযুক্তির বর্তমান বিশ্ব হাতে কাজ করার প্রচুর বিষয়কে যন্ত্র সভ্যতার নবতর ছোঁয়ায় আলোকিতও করছে। যা শুধু নগর, শহর, বন্দরে নয়। বাংলাদেশের এখনো সিংহভাগ অঞ্চল পল্লি জননীর সুশীতল ছায়ায়। ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আবহমান বাংলা তার অনেক সবুজ প্রতিবেশ হারায় নিত্য নতুন প্রযুক্তির অবগাহনে। এমন সুশোভিত সবুজ বাংলায় আজ আর আগের মতো নেই। প্রাকৃতিক বিরূপতা আর জনসংখ্যার ভারে দেশের সমূহ বিপদও ঠৈকাতে হয় প্রতিনিয়ত। গৃহকর্মীর বিষয়টি আনতে গিয়ে আলোকপাত করতে হচ্ছে কৃষি প্রধান বাংলাদেশে শুধু নারী কৃষক নয় বরং ধান কিংবা শাক-সবজির বীজ রোপণ থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত যে পরিচর্যা করতে হয় সেখানে নারীদের অবদান নজরকাড়া। চাষাবাদে লিপ্ত নারীরা নিজের সামান্য জমি ছাড়াও বিভিন্ন সম্পন্ন গৃহস্থের সাহায্যকারী হিসেবে যোগ দিয়ে চাষাবাদে যে ভূমিকা রাখছে তাও এই বাংলার চিরায়ত কর্মযোগ। সেখানে গৃহকর্মীদের বিষয় আলোকপাত করা আর এক রুদ্ধতার জাল। প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত নির্দেশ করছে গৃহে কিংবা কৃষি জমিতে কাজ করা নারীরা সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় জীবন কাটাচ্ছে। স্বস্তিদায়ক পরিবেশ মোটেও নয় বলে সংশ্লিষ্ট উপাত্ত বারবার লোমহর্ষক চিত্রও প্রকাশ করছে। শ্রমের মর্যাদা তো দেওয়াই হয় না। তার চেয়ে বেশি অত্যাচার আর নিপীড়নও চলে হরহামেশাই। প্রকাশ পায় না অনেক নির্মম ঘটনা, যা সংশ্লিষ্টদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সবচেয়ে নিগৃহীতের শিকার হচ্ছে কিশোরী, উদীয়মান তরুণী ও যুবতী নারীরা। কাজের তো কোনো সীমা-পরিসীমাই থাকে না। সবচেয়ে বেশি করে আছে গৃহকর্তা কিংবা তার ছেলের নানামাত্রিক উৎপাত আর শারীরিকভাবে হেনস্তা করার দুঃসহ দুর্বৃত্তায়ন। ভাবা যায় না এমন অকথ্য নির্মম শারীরিক-মানসিক নিপীড়নের নিয়ত দুর্ভোগ আর অসহনীয় যন্ত্রণা। তাদের জন্য আইন আদালতও এক রুদ্ধতার বেষ্টনী। সে পর্যন্ত যাওয়া আর এক নিষ্ঠুরতার বেড়াজাল। তথ্য-উপাত্তে নির্দেশ হচ্ছে ৯৬% গৃহকর্মী তার ওপর হয়ে যাওয়া নির্মমতার অভিযোগ পর্যন্ত করেন না। এমন তথ্যও বিচলিত হওয়ার মতোই। ভালো-মন্দ রান্না তাদের ভাগ্যে কখনো জোটে না বরং মনিবের শিশু সন্তানটিকে যখন খাইয়ে দেয় সে সময় যা উচ্ছিষ্ট থাকে তাই গৃহকর্মীর ভালো-মন্দের জোগাড়। পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না তা কিন্তু নয়। বাসি ভাত-তরিতরকারি সব সময়ের জন্য তারা পেয়ে থাকে। অতিথি এলে অনেক কিছু রান্না করা হলেও কালে-ভদ্রে হয়তো বা জোটে।
বাংলাদেশ গৃহশ্রমিক ‘সুরক্ষা নীতিমালা’ করা হয় ২০১৫ সালে। যেখানে আছে, তাদের ন্যায্য বেতন-ভাতা নির্ধারণ, সুস্থ স্বাভাবিক কর্ম পরিবেশ, কাজের সুনির্দিষ্ট বিষয় আর সময়কে মান্যতা দেওয়া। কর্ম সময় আর বয়স বিবেচনাও নিয়ম-নীতিতে অন্তর্ভুক্তি থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সে সবের ব্যত্যয় হচ্ছে প্রতিনিয়তই। প্রকাশের অভাবে সালিশের দোরগোড়ায় পৌঁছা পর্যন্ত দায় হয়ে পড়ে। আইন-আদালত তো আরও পরের বিষয়। তার ওপর নির্ধারিত আইন বিধি যাতে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা হয় সে জন্য তদারককারি সেলের আবশ্যকতাও বিধি হিসেবে প্রণীত হয়। কিন্তু বাস্তবের চিত্র একেবারেই উল্টো রথ। দু-একটা নজির সার্বিক দুঃসহ ঘটনাপঞ্জিকে প্রতিনিধিত্বও করে না। এখানে বারবার দৃষ্টান্ত হিসেবে খাঁড়া করা হচ্ছে গৃহকর্মী আদুরী হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত আর বিচারিক প্রক্রিয়া। সঙ্গে অর্থদণ্ডও বিবেচনায় রাখা হয়। নীতিমালা থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা গৃহকর্মীরা আসলে জানেও না তাদের জন্য সুরক্ষিত নীতিমালা আছে কি না। থাকলেও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ কিভাবে হবে সেটাও আর এক অজানা বিস্ময়। সঙ্গতকারণে নীতিমালার যথার্থ সুফল ভুক্তভোগীরা পায়ও না। তবে বিশিষ্টজনরাও বলছেন শ্রম আইনে গৃহশ্রমকেও মর্যাদা দেওয়া আবশ্যক। শুধু তাই নয় গৃহশ্রমিকদের নিবন্ধনও জরুরি একটি বিষয়। মানুষ মানুষের জন্য এমন চিরস্থায়ী প্রবাদ যুগে আবর্তনে প্রযুক্তির নিত্যনতুন অভিযাত্রায় বিন্দুমাত্র তার মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ন না হওয়াও মানবতার পরম জয়গান। সেখানে বার্তা আর কর্মের ফারাকও যথা সম্ভব ঘুচিয়ে নেওয়া মানবতার অভাবনীয় জয়মালা। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে নানামাত্রিক ফারাক বিদ্যমান। লড়াই-বিপ্লবেরও কোনো শেষ-পরিশেষ নেই। মমতাভিত্তিক সমাজ শুধু নারী-পুরুষের নয় সর্ব মানুষের মিলনগ্রন্থিতে সমাজ সভ্যতার ভিত্তি মজবুত হবে- এমনই আশা।
অপরাজিতা প্রতিবেদক
প্যানেল