ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ি কন্যার সংগ্রাম

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:৪৫, ৩১ মার্চ ২০২৩

পাহাড়ি কন্যার সংগ্রাম

পাহাড়ি মেলায় ক্যালি চাকমার পণ্যের পসরা

চট্টগ্রামের রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকা। আদিবাসী মানুষের জীবন যুদ্ধের এক লড়াকু ইতিবৃত্ত। সমতল ভূমির মানুষের চাইতেও অনেক কঠিন কঠোর জীবন যাপনে অভ্যস্ত আদিবাসীরা। প্রকৃতিই তাদেরকে সহিষ্ণু জাতি গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলার এক নিয়ামক শক্তি। যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অক্লান্ত পরিশ্রমী, কঠোর জীবনবোধে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। আর লিঙ্গবৈষম্য এখনো আমাদের সমাজে এক প্রচলিত নিয়মবিধি। যা আধুনিক সময়কেও প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে।

আর পাহাড়ি এলাকার জীবনযাত্রা নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি ধর্ম আর জীবনাচরণে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকানো। যুগ যুগ ধরে চলে আসা গতানুগতিক সংস্কারের ব্যত্যয় এখন অবধি অদৃশ্য। তেমনই অচলায়তন এক সামাজিক পরিম-লে ক্যালি চাকমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, জীবন এগিয়ে নেওয়া সবই যেন চলতে থাকে বিধি মোতাবেক। শিক্ষা জীবনও শুরু হয় প্রচলিত নিয়ম অনুসারে। মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন রাঙামাটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। সমাজের অপসংস্কৃতির জের হিসেবে বাল্যবিয়েও ছিল যেন এক কঠিন বলয়। ক্যালি চাকমাও পড়েন বাল্যবিয়ের যাঁতাকলে।

পরিণামে অকাল মাতৃত্ব। তারপরেও সুখের সাক্ষাৎ মেলেনি। স্বামী ছিলেন প্রচ- নেশাগ্রস্ত। নেশার ঘোরে মারও খেয়েছেন প্রচুর স্বামীর হাতে। এক পুত্র সন্তানের মা যারপরনাই চেষ্টা করেও সংসার টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। বিচ্ছিন্নতার যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার সঙ্গেই আরও এক দুর্ভোগ যাপিত জীবনকে দিশেহারা করে দিল। পাহাড়ি আইন কানুনে সন্তান বাবার কাছে থাকার অনুমতি পেল। সহায় সম্বলহীন মায়ের দৈন্যতার কারণে একমাত্র পুত্রকে নিজের কাছে রাখার অনুমতিই পেল না ক্যালি। শোকে, দুঃখে, অনুতাপে ক্যালির মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শয্যাশায়ী হলেন।

এক সময় জীবন প্রদীপও নিভে গেল জন্মদাত্রী মায়ের। ক্যালির চোখে তখন নিকষ কালো আঁধার। আরও এক দুর্বিপাক তাকে হতভম্ব করে দেয়। পিতার সন্ন্যাসী হওয়ার তাড়নায় গৃহত্যাগ। ঘরে শুধু একমাত্র ভাই আর তিনি নিজেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে উদীয়মান এক লড়াকু তরুণী যেন সংকটের স্রোতে ভেসে গেলেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। রাঙামাটি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করলেন। এদিকে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে সমাজ সংস্কারের অবহেলা, ধিক্কার, তিরস্কার, সবই মাথা পেতে নিয়ে অন্য কিছুকে তোয়াক্কাই করলেন না।

ভেতরের বোধে অনুক্ষণ জ্বালা ধরতো একমাত্র সন্তানকে কাছে না পাওয়ার দুঃসহ মর্মবেদনা। যা আজ পর্যন্ত বহন করে চলছেন। সময়টা ২০১২ থেকে ২০১৩ সাল। ঘুরে দাঁড়ানোর মাইলফলক। পাহাড়ি এলাকা নিজস্ব পোশাক সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। খাদি কাপড়ের পোশাকে লুঙ্গি ও টপস। সেখান থেকে ক্যালি চাকমার নবতর উত্থান। একজন উদ্যোক্তার কাতারে নিজের শ্রম আর কর্মযোগকে অবারিত করা। যুক্ত হলেন বিভিন্ন টেক্সটাইলের সঙ্গে। বিসিক ও ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের নব উদ্যোক্তার কাতারে দাঁড়াতে হলে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা আবশ্যক।

এখান থেকেই আসে ১ লাখ টাকার ঋণ সহায়তা। সূতা কিনে পোশাক শ্রমিকদের কাছে তা দিয়ে নতুন পরিচ্ছদ বানানোই এই উদ্যোক্তার পণ্য উৎপাদনের মূল সারবত্তা। আর পণ্যের মূল্য নির্ধারণ শুধু শ্রমিকের মজুরি দিয়ে নয় আরও বেশি করে সম্পৃক্ত থাকে মূল উপাদান সুতার দাম। একসময় সুতার কেজি ছিল ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। বাজার দরের ঊর্ধ্বগতিতে তা এখন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার উপরে। ফলে পণ্য উৎপাদনে খরচ বেশি হলেও বিক্রিতে তার প্রভাব পড়তে সময়ও লাগে। ক্যালি চাকমার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা এই পাহাড়ি অঞ্চলকে সমৃদ্ধ আঙিনা উপহার দিচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে।

৫০ জন নারী উদ্যোক্তা নিয়ে তাদের সংগঠন ‘রাঙামাটি নারী, উদ্যোক্তা উন্নয়ন সংস্থা’। যার সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করছেন তিনি নিজেই। তবে পুরুষশাসিত সমাজের হরেক দুর্বিপাকে পাহাড়ি এলাকাটি গভীরভাবে নিমজ্জিত। স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে ক্যালিকে সমাজ উত্ত্যক্ত করতেও ছাড়েনি। তবে বহাল তবিয়তে নাকি স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহে সামাজিক কোনো প্রতিবন্ধকতাই তৈরি হয়নি। সব কিছু তিক্ততার সঙ্গে উপলব্ধি করতে গিয়ে তার অভিব্যক্তিÑ আমি এখন স্বাবলম্বী। আমার সন্তানের ভরণ পোষণ করার সক্ষমতাও আছে এখন। তারপরেও আমার ছেলেকে সৎ মায়ের কাছে থাকতে হয়। 
এ ব্যাপারে কট্টর সমাজ নির্লিপ্তÑবাকরুদ্ধ। মানাই যায় না। জীবনটা চলছে এখন স্বচ্ছন্দগতিতে, নিরুদ্বেগ, নির্বিঘেœ। কিন্তু ছেলেকে নিজের কাছে না পাওয়ার অপ্রাপ্তি ভেতর থেকে মোছাই যাচ্ছে না। তবে আরও এক কঠিন অভিব্যক্তি ক্যালি চাকমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে। তবে তা শুধু নিজের জন্য নয় বরং সকলের জন্য একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চান। যেমন বিয়ের আগে মেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রম সমাপ্তই শুধু নয় স্বাবলম্বী হয়েও নিজের পায়ে দাঁড়ানো একান্ত জরুরি।

ক্যালি মনে করেন বিয়ের আগে যদি তিনি উপার্জনক্ষম হতে পারতেন তাহলে শুধু পাহাড়ি কেন অন্য কোনো আইনে তার কাছ থেকে সন্তানকে আলাদা করার কোনো যুক্তিই থাকতো না। যেমন সন্তানের পিতার বেলায় সে সব কিছুর প্রশ্নই ওঠেনি। বাল্যবিয়ে আমাদের রক্ষণশীল সমাজের চিরায়ত এক কট্টর প্রথা। যা আধুনিক সময়েও সংশ্লিষ্টদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। প্রসঙ্গত নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার উক্তি স্মরণযোগ্য।

তিনি বলেছিলেন- একজন অবোধ বালিকাকে বিয়ে দিতে যা খরচ হয় তার অর্ধেক হলেই কন্যা শিশুটি লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেÑ বাকি জীবনটা আপন গতিতে চলতেও তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে এখনো যা নজির হিসেবেই শুধু উল্লেখ করছি। বাস্তবে নয়।

×