ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০ চৈত্র ১৪২৯

monarchmart
monarchmart

সুচের ফোঁড়ে কষ্টের অবসান

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

সুচের ফোঁড়ে কষ্টের অবসান

নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের বাসিন্দা মর্জিনা খাতুনের

পাঁচ বছর আগেও স্বামী ও তিন সন্তানসহ অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটত নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের বাসিন্দা মর্জিনা খাতুনের। দিনমজুর স্বামী যা আয় করতেন, তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলত। সেই মর্জিনার দুঃখ কষ্টের গল্প এখন অন্যরকম। তিন সন্তান স্কুলে যায়। স্বামী-সন্তান নিয়ে বেশ ভালোই কাটছে তার দিন। শুধু মর্জিনা একাই নন। শাড়ি, থ্রি-পিস পাঞ্জাবিতে নকশার কাজ করে মর্জিনার মতো মিথিলা পারভীন, শাহানাজ বেগম, হাসিনা বেগম, ফরিদা আক্তারসহ সৈয়দপুর উপজেলায় তিন হাজার নারী তাদের দুঃখ কষ্ট সরিয়ে নিজেদের স্বচ্ছলতায় ভাগ্য বদলে ফেলেছেন।

ঈদ ঘনিয়ে আসার আগেই ব্যস্ততা বেড়েছে সৈয়দপুরের তিন হাজার নারীর। জর্জেট ও সিল্কের থান কাপড়ের ওপর পুঁতি, পাথর ও চুমকি বসিয়ে তারা তৈরি করছেন নানা ডিজাইনের বাহারি শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক। বর্তমানে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। শুধু দেশ নয়, বিদেশেও এসব হস্তশিল্পীদের কাজ করা শাড়ি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি বা শিশু পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। 
বুটিকস কারিগররা শুধু ক্যাটালগ দেখে বিভিন্ন ডিজাইনের নকশা ও পাথর বসিয়ে কাজ শেষ করেন। নকশার কাজে ওয়েট লেইস, মাখন, লেদার জর্জেট, পাথর, জরি, চুমকি, মাল্টি পুঁতি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এরপর কাপড় ও কাজের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়। এখানে শাড়ির দাম নির্ধারণ হয় ডিজাইন ভেদে। এবারের ঈদে বেশি কাজ করা হবে পার্টি শাড়ি ও লেহেঙ্গা শাড়ির। ছুফিয়ান,  নেট, শিপন ও লেক্সমি কাপড়ের ওপর বিভিন্ন ডিজাইনে প্রতিটি শাড়ির দাম ৪ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বুটিকস কারিগর মর্জিনা খাতুন জানান, ঈদকে সামনে রেখে ৬ মাস আগে থেকে কাজ শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কাপড় দিয়ে অর্ডার দিয়ে যান। রোজার প্রথম সপ্তাহের পর আর অর্ডার নেওয়া হয় না। এক সময়ে গ্রাম্য নারীরা রান্নার কাজ আর সন্তান লালন পালন ছাড়া অন্য কাজ করতেন না। সময় পেলে শখের বশে নকশিকাঁথা, বালিশের কাভারে ফুল আঁকাসহ বিভিন্ন কাজ করতেন। কিন্তু গ্রাম্য এসব নারীর মানসিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তারা এখন আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।

মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বেশ বদলে গেছে এখানকার নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। হস্তশিল্পের বর্ণিল আভায় আলোকিত এখন এখানকার। শহর ও গ্রামাঞ্চলের বেকার যুবক-যুবতী ও গৃহবধূরাও ঝুঁকছেন হস্তশিল্পের দিকে। ইতোমধ্যে প্রশিক্ষিত হয়ে বাড়িতে ও কারখানায় কাজ করে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করছেন। শুধু তাই নই, অভাবী সংসারে জন্ম নেওয়া অনেক শিক্ষার্থী এ কাজ করে পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন। যা এলাকায় বাল্যবিবাহ রোধ করছে অনেক। 
ইসলামবাগ, গোলাহাট, মিস্ত্রিপাড়া ও বাঁশবাড়ি এলাকায় দেখা যায়, এলাকার নারীরা শাড়িতে নকশা তোলার কাজ করছেন। সবাই শাড়িতে সুই দিয়ে চুমকি, জরি, পুঁতি বসানোর কাজে ব্যস্ত। একটি সাধারণ জর্জেট শাড়ি নকশার পর হয়ে উঠছে অসাধারণ।
ইসলামবাগ এলাকার বাসিন্দা মিথিলা পারভীন বলেন, ৮ বছর আগে আমার বিয়ে হয় দিনাজপুরের পার্বতীপুর শহরের সাহেবপাড়া এলাকার হামিদুল ইসলামের সঙ্গে। সামান্য কিছু কৃষি জমিতে স্বল্প আয় হতো। স্বামীকে নিয়ে অভাবের কারণে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তিন বছর আগে শুরু করি শাড়িতে নকশা তোলার কাজ। এখন নিজের বাড়ি ও কিছু আবাদি জমি কিনেছি। শাড়িতে নকশার কাজ করে মাসে  ১৮  হাজার টাকা আয় করি।
বাঁশবাড়ি এলাকার শাড়িতে নকশা তোলার কারিগর শাহনাজ পারভীন জানান, উজ্জ্বল রঙের ওপর নকশাগুলো ফোটে ভালো। একটি জর্জেট বা টিস্যু শাড়িতে নকশার কাজ করতে একজন কারিগরের পাঁচ-ছয় দিন সময় লাগে। শাড়ি বা তৈরি পোশাকের ব্যবসায়ীরা অর্ডার দিয়ে  নকশার কাজ করিয়ে নেন। তারাই কাজ করার প্রয়োজনীয় সুই, সুতা, চুমকি, জরি ও পাথর সরবরাহ করেন। 
বুটিকস কারিগর আছিয়া খাতুন জানান, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনমজুর স্বামী জসিম মিয়ার সামান্য উপার্জনে তাদের পরিবারে দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। পরে জর্জেট, সিল্কের থান কাপড়ের ওপর পাথর, চুমকি ও পুঁতি বসানো কাজ শুরু করি। আমরার মতো অনেক নারী এই কাজ করে দুঃখ কষ্টের সংসারে সচ্ছলতা আনতে পেরেছি। তিনি বলেন আমাদের হাতের কাজের শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি ও শিশু পোশাক  ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে তাদের কাজের পরিধি কয়েকগুণ বেড়েছে।
সৈয়দপুর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নুরুন্নাহার শাহাজাদী বলেন, এ উপজেলার শহর ও গ্রামের নারীদের আমাদের অধিদপ্তরের অধীনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে শাড়িতে কারচুপি ও নকশার কাজ করে অভাব দূর করেছেন। তাদের মতো অন্যরাও প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে।

monarchmart
monarchmart