ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাক্ষ্য আইন সংশোধন ॥ অসম্মান থেকে সুরক্ষা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:১৫, ১১ নভেম্বর ২০২২

সাক্ষ্য আইন সংশোধন ॥ অসম্মান থেকে সুরক্ষা

নারী নিপীড়ন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এক চরম বিভীষিকা

নারী নিপীড়ন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এক চরম বিভীষিকা। প্রচলিত বিধি সংস্কারে আটকানো শ্রেণি বিভক্ত সমাজ যুগ যুগ ধরে চলে আসা অসাম্য, বৈষম্যের দৃষ্টিকটু বহির্প্রকাশ। যেখানে মানুষে মানুষে প্রভেদ দৃশ্যমান সেখানে নারী পুরুষের অসম অব্যবস্থাপনা সামাজিক অপসংস্কৃতির কোপানলে আবর্তিত। অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং শারীরিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই সমসংখ্যক নারী কোন না কোন বিভাজনের আওতায় পড়া যেন সেই গতানুগতিক নিয়মবিধির অভেদ্য বাঁধন।

শুধু তারতম্য নয় যে মাত্রায় অত্যাচার, নিপীড়ন আর সহিংসতার শিকার হয় সেখানে যথার্থ বিচার পাওয়াও চলে আসা আইনানুগ ধারার চরম বিপত্তি। আমাদের দেশেও সেই পুরাকালের ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইনের অনুশাসন এখনো বিচার ব্যবস্থাকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে রেখেছে। ফলে একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক যুগেও সেই ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শাসন করা উপনিবেশিক সরকারের হাতে প্রণীত আইনি কার্যক্রম এখনো বহাল তবিয়তে চলমান।

সময়ের দাবিতে যুগের চাহিদায় আর আধুনিকতার নির্মাল্যে বিধিবদ্ধ হরেক কট্টর নিয়মনীতির রূপান্তর ঘটিয়ে আইনি ব্যবস্থাকে শুধু যুগোপযোগীই নয় বরং সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসাও এক প্রকার আইনি সংস্কারের নবতর বিধান। কিন্তু শুরুতে যা বলা হয়েছে, সমসংখ্যক নারী সেই যুগ-যুগান্তরের শৃঙ্খলে শুধু আটকা পড়া নয় বরং মান্ধাতা আমলের নিয়ম-নীতির আবর্তে পড়াও দুঃসহ পরিস্থিতির চরম দুর্বিপাক। কোন নারী যদি তার সম্ভ্রমহানিতার জন্য অভিযোগ জানায় সেখানে ধর্ষকের বিচারের আগে হিসাব নিকাশ করা হয় নাজেহাল হওয়া মেয়েটির অতীত ইতিহাস।

এছাড়া ভুক্তভোগীর চারিত্রিক স্খলন এবং পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতাও। বর্তমানে সেখানে নিয়ে আসা হচ্ছে যুগান্তকারী রূপান্তরই শুধু নয় বরং বিধিনিষেধও থাকছে ভুক্তভোগীকে অকারণে অপ্রয়োজনে প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করাও। নতুন এই বিধান সেই পুরাকালের উপনিবেশিক শাসনের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী প্রস্তাব ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। অত্যাচারিত নারীর জন্য শুধু সুবিচার পাওয়া নয় তার চেয়ে বেশি তার মানসম্মান, মর্যাদার ব্যাপারটিও সংশোধনী আইনে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

নারী নির্যাতন আইনের নবযাত্রা তো বটেই। এভিড্যান্স এ্যাক্ট ১৮৭২ (অ্যামেন্ডমেন) বিল-২০২২ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়। সম্মিলিত কণ্ঠভোটে তা পাস হওয়াও নবতর বিধানকে স্বাগত জানানো। বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান যাত্রায় প্রতিনিয়তই এগিয়ে যাচ্ছে। অর্ধাংশ নারী অদম্য মনোবলে দুঃসাহসিক যাত্রা পথের অংশীদার হতে মোটেও পেছনের দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু দৃষ্টিনন্দন উন্নত, আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ হরেক মাত্রার অপসংস্কৃতিকে সেই প্রাচীনতম বিধি ব্যবস্থায় আটকেও রেখেছে।

তেমন দুঃসহ পথযাত্রায় সব থেকে বেশি বিপন্ন অবস্থার শিকার হচ্ছে সমসংখ্যক নারী। সঙ্গতকারণে গতানুগতিক বিধি ব্যবস্থা যা কোন কালকেই প্রতিনিধিত্ব করে না বরং বিভিন্ন শ্রেণির ওপর অন্যায়, অপবাদ চাপানো ছাড়াও তার সহজাত মানসম্মান নিয়েও প্রশ্নবাণে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সেখানে বর্তমান সরকার ভুক্তভোগী নারীদের সার্বিক কল্যাণ কামনায় এমন এক অসাধারণ আইনি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন যা শুধু অপরাধীকেই শাস্তির আওতায় নিয়ে এসে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সর্ববিধ ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করবে।

নতুন সংশোধনী আইন পাস হওয়ার কারণে এতদিন চলে আসা আইনটির ধারা বাতিলের খাতায় চলে যাবে। আগের ধারায় যা দৃশ্যমান হতো শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনার পরই প্রথম যে বিষয়টি উঠে আসতো তা হলো ভুক্তভোগী নিজেই দুশ্চরিত্র কিনা। সেটা প্রবল জেরার মুখে আদায় করার চেষ্টা করা হতো।
নতুন আইনে সেটা করার সব পথই রুদ্ধ করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে নির্যাতিতা তার অতীতের কোন কিছুকে আইনি কার্যক্রমের ধারায় প্রকাশ করবে না। বিশেষ করে তার নৈতিক চরিত্র এবং অতীতের কোনো আচার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা নতুন আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধের ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। যথার্থ বিচারিক মানদ- নিরিখের বেলায় তাও আদালতের পরামর্শেই জেরা করার নির্দেশ দেওয়া আছে।

ভুক্তভোগী যাতে কোন ধরনের অশালীন কিংবা রুচিহীন অবস্থার শিকার হতে না পারে সেটাও দেখবেন মহামান্য আদালত। সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মকর্তা এবং বিশিষ্ট আইনবিদরা দীর্ঘদিন ধরে উপনিবেশিক আমলের এমন আইনের ধারাকে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। যে আইনটি মূলত নতুন সময়ের প্রেক্ষাপটে সাংঘর্ষিক এবং পুরনো বিধি সংস্কারে জর্জরিত।

এছাড়া নতুন এই আইন প্রযুক্তির আঙিনায় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহকেও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় এনেছে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তিতে জাল কিংবা অসত্য উপাত্তের কোন সুযোগ থাকে না। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও আদালত যদি মনে করে আরও নির্ভরযোগ্য তথ্যের দরকার তাহলে সাক্ষ্য প্রমাণের ফরেসনিক পরীক্ষাকেও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। তথ্য উপাত্ত সুরক্ষা আইন প্রয়োগের আগে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করা হবে। নির্দ্বিধায় বলা যায় আইনটি আধুনিক এবং যুগান্তকারী। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকও বটে।

×