
ছবি: সংগৃহীত
ঘুম শুধু ক্লান্তি দূর করার মাধ্যম নয়, এটি আমাদের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য অপরিহার্য। আধুনিক ব্যস্ত জীবনযাত্রায় অনেকেই পর্যাপ্ত ঘুমানোর সময় পান না বা ঘুমকে তেমন গুরুত্ব দেন না। কিন্তু দিনের পর দিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে তা অজান্তেই আমাদের শরীরের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং বিভিন্ন ভয়ংকর রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। চিকিৎসকরা বলছেন, কম ঘুমকে কখনোই ছোট করে দেখা উচিত নয়, কারণ এটি আপনার স্বাস্থ্যের 'নীরব ঘাতক' হয়ে উঠতে পারে।
চলুন, জেনে নেওয়া যাক কম ঘুমানোর কারণে আপনি অজান্তেই কোন কোন ভয়ংকর রোগগুলো ডেকে আনছেন:
১. হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি:
কীভাবে ক্ষতি করে: পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায়, যা হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। কম ঘুম শরীরে প্রদাহ বাড়ায় এবং স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা রক্তনালীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাবে ধমনীগুলোতে চর্বি জমার (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস) ঝুঁকি বাড়ে, ফলে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়।
২. ডায়াবেটিস টাইপ ২ এর ঝুঁকি:
কীভাবে ক্ষতি করে: কম ঘুম ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়। এর অর্থ হলো, শরীর ইনসুলিনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। এটি দীর্ঘমেয়াদে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। ঘুমের অভাবে ক্ষুধার হরমোন গ্রেহলিনের মাত্রা বাড়ে এবং তৃপ্তির হরমোন লেপটিনের মাত্রা কমে, যা অতিরিক্ত ক্ষুধা বাড়িয়ে তোলে এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করে, ফলে ওজন বাড়ে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আরও বাড়ে।
৩. স্থূলতা বা ওজন বৃদ্ধি:
কীভাবে ক্ষতি করে: যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ঘুমের অভাবে গ্রেহলিন ও লেপটিন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। গ্রেহলিন ক্ষুধা বাড়ায় এবং লেপটিন পূর্ণতার অনুভূতি দেয়। কম ঘুম হলে গ্রেহলিন বাড়ে ও লেপটিন কমে, ফলে সারাক্ষণ ক্ষুধা লাগে এবং বেশি বেশি খাওয়া হয়। এছাড়াও, ঘুমের অভাবে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং শরীর ক্যালরি পোড়াতে পারে না, যা দ্রুত ওজন বাড়িয়ে দেয়।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া:
কীভাবে ক্ষতি করে: ঘুম শরীরকে বিশ্রাম ও পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ দেয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে আপনি সহজেই ফ্লু, সর্দি-কাশি এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি গুরুতর রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতাও কমে যায়।
৫. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি (বিষণ্নতা ও উদ্বেগ):
কীভাবে ক্ষতি করে: ঘুমের অভাব মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। এটি মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট করে, যা মেজাজ, অনুভূতি এবং মানসিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘমেয়াদী কম ঘুম বিষণ্নতা, উদ্বেগ, খিটখিটে মেজাজ এবং মনোযোগের অভাবের কারণ হতে পারে। স্লিপ ডেপ্রিভেশন অনেক সময় সিদ্ধান্তহীনতা এবং স্মৃতিশক্তির দুর্বলতাও ঘটায়।
৬. দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি:
কীভাবে ক্ষতি করে: কম ঘুম মস্তিষ্কের সজাগতা এবং প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে ড্রাইভিং করার সময় বা কোনো মেশিন চালানোর সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কর্মক্ষেত্রে বা দৈনন্দিন জীবনেও ভুল করার প্রবণতা বাড়ে।
৭. ত্বকের সমস্যা এবং দ্রুত বার্ধক্য:
কীভাবে ক্ষতি করে: ঘুমের সময় শরীর কোষ মেরামত এবং পুনর্গঠনের কাজ করে। কম ঘুম হলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যার ফলে ত্বকে বলিরেখা, নিস্তেজতা এবং চোখের নিচে কালি পড়ে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে স্ট্রেস হরমোন বাড়ে, যা ত্বকের কোলাজেন ভেঙে দেয় এবং ত্বক দ্রুত বুড়িয়ে যায়।
কী করবেন?
এই ভয়ংকর রোগগুলো থেকে বাঁচতে হলে পর্যাপ্ত ঘুমকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
একটি নির্দিষ্ট ঘুমের সময়সূচী অনুসরণ করুন, এমনকি ছুটির দিনেও।
ঘুমের আগে ক্যাফেইন বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন।
ঘুমানোর আগে ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার বন্ধ করুন।
ঘুমের পরিবেশ আরামদায়ক ও অন্ধকার রাখুন।
যদি ঘুমের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ঘুম আপনার স্বাস্থ্যের এক অমূল্য সম্পদ। একে অবহেলা করলে তার মূল্য অনেক বড় হতে পারে। আজই আপনার ঘুমের অভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হোন এবং একটি সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করুন।
ফারুক