ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে সত্য প্রমাণিত হলো আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২৯ জুলাই ২০২৫

কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে সত্য প্রমাণিত হলো আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের এক শতাব্দী পুরনো ভবিষ্যদ্বাণী আবারও সত্য প্রমাণিত হলো। কৃষ্ণগহ্বরের ঠিক কিনারায় এমন একটি এলাকা রয়েছে, যেখানে বস্তু আর কক্ষপথে ঘোরাফেরা করতে পারে না—বরং ভয়ঙ্কর গতিতে গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই এলাকাকে বলা হয় ‘Plunging Region’, এবং বিজ্ঞানীরা এবারই প্রথম একে সরাসরি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু মামারি নেতৃত্বাধীন গবেষণা দলে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। তাদের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে Monthly Notices of the Royal Astronomical Society জার্নালে।

‘এতোদিন এই এলাকাটাকেই উপেক্ষা করা হচ্ছিল’

অ্যান্ড্রু মামারি বলেন, ‘আমরা এতদিন এই অঞ্চলটা উপেক্ষা করেছি, কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না। এখন যখন সেই তথ্য হাতে এসেছে, তখন এটা ব্যাখ্যা করার আর কোনো বিকল্প নেই—আইনস্টাইন ঠিকই বলেছিলেন।’

প্রায় ১০ হাজার আলোকবর্ষ দূরের একটি কৃষ্ণগহ্বর—যার নাম MAXI J1820+070—এই গবেষণার মূল কেন্দ্রে ছিল। এটি একটি নক্ষত্র ও কৃষ্ণগহ্বরের যুগল ব্যবস্থায় অবস্থিত। নাসার NuSTAR ও NICER এক্স-রে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন কীভাবে একটি নক্ষত্র থেকে আসা গরম গ্যাস (প্লাজমা) কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে টেনে নেওয়া হয়।

‘নদীর শেষ প্রান্তের ঝরনার মতো’

অ্যান্ড্রু মামারি এই ‘Plunging Region’-কে তুলনা করেছেন নদীর শেষ প্রান্তের এক বিশাল ঝরনার সঙ্গে। তাঁর ভাষায়, ‘সাধারণত কৃষ্ণগহ্বর ঘিরে যে বিশাল গ্যাসীয় চাকতি (accretion disk) থাকে, সেটি নদীর মতো শান্তভাবে ঘুরতে থাকে। কিন্তু শেষ প্রান্তে এসে আচমকা সেই সাপোর্ট চলে যায়, সবকিছু গড়গড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষ্ণগহ্বরে।’

এই নতুনভাবে শনাক্ত করা অঞ্চলটি ইভেন্ট হরাইজন বা কৃষ্ণগহ্বরের মূল সীমানার ঠিক বাইরের অংশে অবস্থিত। ইভেন্ট হরাইজনে একবার ঢুকে গেলে কোনো আলো বা বিকিরণ বের হতে পারে না, কিন্তু Plunging Region-এ আলো এখনও বের হয়—যদিও বস্তু শেষমেশ গিলে ফেলে ভয়ঙ্কর মাধ্যাকর্ষণ।

কী কাজে আসবে এই আবিষ্কার?

এই এলাকা পর্যবেক্ষণ করে কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণনের গতি, আকৃতি ও গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ অধ্যাপক ক্রিস্টোফার রেইনোল্ডস বলেন, ‘Plunging Region-এর অস্তিত্বের প্রমাণ আমাদের কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কিত মডেলগুলোর বিশাল উন্নতি ঘটাবে।’

কৃষ্ণগহ্বরের ছবি নয়, এবার ভিডিও!

যদিও এই গবেষণায় কৃষ্ণগহ্বরের সরাসরি কোনো ছবি তোলা সম্ভব হয়নি (কারণ এটি অত্যন্ত দূরে ও ক্ষুদ্র), তবে অক্সফোর্ডের আরেকটি গবেষক দল একটি আরও সাহসী প্রকল্পে কাজ করছেন—প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ভিডিও তৈরির পরিকল্পনা।

এই কাজের জন্য নামিবিয়াতে নির্মিত হবে নতুন এক টেলিস্কোপ—Africa Millimetre Telescope। এটি Event Horizon Telescope প্রকল্পের অংশ হবে, যে টেলিস্কোপ ২০১৯ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তুলেছিল।

পুরনো আলোড়ন ও নতুন মিল

২০১৮ সালে আমাদের ছায়াপথের এক কৃষ্ণগহ্বর থেকে বিশাল এক আলো বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যার সঙ্গে উচ্চ-শক্তির এক্স-রে দেখা গিয়েছিল। তখন কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেছিলেন যে সেটি Plunging Region-এরই ফল। এবার গবেষণায় এই ধারণার পেছনের গাণিতিক প্রমাণও পাওয়া গেল।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ড্যান উইলকিনস বলেন, ‘এই Plunging Region এখন পরবর্তী দশকের একটি প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র হয়ে উঠবে, যেখানে উন্নত এক্স-রে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কৃষ্ণগহ্বরের সবচেয়ে গভীর ও গোপনীয় অঞ্চলগুলো পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে।’

বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো আইনস্টাইনের পূর্বাভাস দেওয়া কৃষ্ণগহ্বরের ‘ঝাঁপিয়ে পড়ার অঞ্চল’ শনাক্ত করেছেন। এটি কৃষ্ণগহ্বরের গঠন, বিকিরণ ও বিকাশ সম্পর্কে বিশাল তথ্য দেবে, এবং ভবিষ্যতে কৃষ্ণগহ্বরের ভিডিও তৈরির দিকেও এক ধাপ এগিয়ে গেল বিশ্ব।

 

সূত্র: সিএনএন।

রাকিব

×