
ছবি: সংগৃহীত
আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো—সময় ঠিকভাবে হিসাব রাখা। আপনি কি জানেন, কোনো পাহাড়ের চূড়ায় সময় একটু দ্রুত চলে, আর উপত্যকায় একটু ধীরে?
সাধারণ মানুষদের জন্য এই পার্থক্য খুব একটা গুরুত্ব না পেলেও, চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরির প্রতিযোগিতায় নামা যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং অন্যান্য দেশগুলোর জন্য এটি হয়ে উঠেছে এক বড় চ্যালেঞ্জ।
চাঁদের পৃষ্ঠে একটি দিন পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৫৬ মাইক্রোসেকেন্ড কম সময় ধরে চলে। এই সামান্য পার্থক্যও দীর্ঘমেয়াদে বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে—বিশেষ করে যোগাযোগ, নেভিগেশন ও গবেষণায়।
এজন্যই নাসা ও তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগীরা এখন চাঁদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি ‘টাইম স্কেল’ বা সময় পরিমাপের পদ্ধতি তৈরির কাজে হাত দিয়েছে।
টাইম জোন নয়, টাইম স্কেল
নাসার ‘লুনার পজিশন, নেভিগেশন অ্যান্ড টাইমিং স্ট্যান্ডার্ডস’ প্রকল্পের প্রধান শেরিল গ্র্যামলিং বলেন, ‘আমরা চাঁদের জন্য নতুন টাইম জোন নয়, বরং একটি নিজস্ব টাইম স্কেল তৈরি করছি, যেখানে সেকেন্ড একটু দ্রুত কেটে যাবে।’
এই সময় স্কেল সব মহাকাশযাত্রা ও অনুসন্ধানের ভিত্তি হয়ে উঠবে। হোয়াইট হাউস ইতোমধ্যে নাসাকে নির্দেশ দিয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে এই সময় স্কেল তৈরি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য। কারণ ২০২৬ সালেই প্রথমবারের মতো আবারও চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
সময়ের রহস্য
সময়ের পরিমাপ নিয়ে আমাদের ধারণা অনেকটাই পরিবর্তিত হয় আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্বের পর। তাঁর মতে, মহাকর্ষ (gravity) সময়কে ধীর করে দেয়। এ কারণেই, একটি পারমাণবিক ঘড়ি যদি সমুদ্রপৃষ্ঠে রাখা হয়, তাহলে তা পাহাড়ের চূড়ার ঘড়ির তুলনায় একটু ধীরে চলবে।
এই সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক ঘড়ির সাহায্যে পৃথিবীজুড়ে একটি অভিন্ন সময় তৈরি করেছেন—যার নাম Coordinated Universal Time (UTC)।
কিন্তু চাঁদে এমন UTC কাজ করবে না, কারণ সেখানে সময়ের গতি ও মহাকর্ষ ভিন্ন।
চাঁদের ঘড়ি: প্রযুক্তির প্রয়োগ
চাঁদে মানুষ নামলে তারা ঘাঁটি থেকে বের হয়ে কাজ করবে, রোভার চালাবে, যোগাযোগ রক্ষা করবে—আর এই সব কিছুর জন্য সময়ের হিসাব রাখতে হবে চাঁদের নিজস্ব সময় অনুসারে। গ্র্যামলিং বলেন, ‘যখন নভোচারীরা চাঁদের পৃষ্ঠে থাকবে, তাদের সময়ও হতে হবে চাঁদকেন্দ্রিক।’
নাসার পরিকল্পনায় রয়েছে চাঁদের কক্ষপথে ও পৃষ্ঠে একাধিক টাইম-ডিভাইস স্থাপন করা—যার মধ্যে রয়েছে মহামূল্যবান পারমাণবিক ঘড়ি (Atomic Clock) ও তুলনামূলক সাশ্রয়ী Crystal Oscillator।
একটি মহাকাশযাত্রার উপযোগী পারমাণবিক ঘড়ির দাম হতে পারে কয়েক মিলিয়ন ডলার, কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। অন্যদিকে, সস্তা Oscillator দিয়ে কাজ চলবে না—কারণ তা মিলিসেকেন্ড বা আরও বেশি ভুল করতে পারে, যা নেভিগেশনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
চাঁদের ঘড়ির নেটওয়ার্ক: লুনা নেট
নাসার LunaNet নামের একটি পরিকল্পনা রয়েছে, যেটি হবে চাঁদভিত্তিক ইন্টারনেট ও নেভিগেশন সিস্টেমের মতো। এর ভিত্তিই হবে নতুন টাইম স্কেল।
এখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA) সহ অনেক দেশের অংশগ্রহণ থাকবে। তবে চীন ও অন্যান্য মিত্র নয় এমন দেশ এই উদ্যোগে যুক্ত হবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত।
চাঁদে সময়ের অনুভব হবে ভিন্ন
চাঁদে দিনের পর দিন সূর্য ওঠে না বা অস্ত যায় না। চাঁদের একদিকে ১৪ দিন ধরে সূর্যালোক থাকে, আর পরবর্তী ১৪ দিন থাকে অন্ধকার। ফলে চাঁদের বসবাসকারীরা সময়কে পৃথিবীর মতো অনুভব করতে পারবেন না।
নাসা এখন দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে মানুষ নামানোর কথা ভাবছে—যেখানে কিছু অঞ্চল চিরকাল আলোয় ভাসে, আবার কিছু অঞ্চল চিরকাল ছায়ায় ঢাকা। সেখানে সময়ের ধারণা সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা পাবে।
আগামীর প্রস্তুতি
গ্র্যামলিং বলেন, ‘আমরা চাঁদে সময় ব্যবস্থার যে ভিত্তি তৈরি করছি, সেটিই আমাদের পরবর্তীতে মঙ্গল বা আরও দূরের গ্রহে সময় হিসাব করার অভিজ্ঞতা দেবে।’
নতুন টাইম স্কেল কেবল ঘড়ির কাঁটার হিসাব নয়—এটি হবে ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের ভিত্তি।
সূত্র: সিএনএন।
রাকিব