ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

ভিড় নয়, ভিন্ন অভিজ্ঞতা খুঁজে নেওয়ার ডাক দিচ্ছে স্পেন

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ১০ জুলাই ২০২৫

ভিড় নয়, ভিন্ন অভিজ্ঞতা খুঁজে নেওয়ার ডাক দিচ্ছে স্পেন

গত দুই বছর ধরে স্পেনে গ্রীষ্ম মানেই পর্যটনবিরোধী প্রবল প্রতিবাদ। বার্সেলোনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়দের পানির পিস্তলের শিকার হচ্ছেন পর্যটকরা, আবার বালেয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে “তোমাদের স্বর্গ আমাদের দুঃস্বপ্ন” ব্যানারে বিক্ষোভকারীদের পদযাত্রা হয়ে উঠেছে সংবাদমাধ্যমের নিয়মিত শিরোনাম।

পর্যটন স্পেনের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ— জাতীয় জিডিপির ১২ শতাংশেরও বেশি আসে এ খাত থেকে। তবে যেসব শহরে ক্রুজ জাহাজ প্রতিনিয়ত হাজারো পর্যটক নামিয়ে দেয় আর এয়ারবিএনবি-ধাঁচের ভাড়া ঘরগুলো কেন্দ্রীয় শহরজুড়ে বাসস্থান সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে, সেসব জায়গায় এই বার্ষিক পর্যটনের ভিড় এখন সংঘাতের রূপ নিচ্ছে।

তবে পর্যটকরা থেমে যাচ্ছেন না। স্পেনের ট্যুরিজম অফিসের লন্ডন শাখার পরিচালক মানুয়েল বাটলার জানান, ৮০ শতাংশের বেশি পর্যটক দ্বীপ ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলেই যান, তাও মূলত গ্রীষ্মকালে।

তিনি বলেন, “স্পেনকে আরও পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে টেকসই পর্যটন মডেলের নেতৃত্ব দিতে হবে। এজন্য আমরা পর্যটকদের কম পরিচিত অঞ্চল ঘুরতে, দীর্ঘ সময় থাকতে এবং মৌসুমের বাইরেও ভ্রমণে উৎসাহিত করছি।”

যারা ভিড়ের সমস্যা না বাড়িয়ে বরং সমাধানে অংশ নিতে চান, তাদের জন্য স্পেনে আছে এমন অনেক গন্তব্য যেখানে তারা শুধুই পর্যটক নন— বরং আতিথেয়তার সাদরে গ্রহণযোগ্য অতিথি।

লা রিওহা: মদের রাজ্য, তবে শুধু তাই নয়

স্পেনের উত্তরে পিরেনিজ পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত লা রিওহা প্রদেশ বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম কম ঘোরাফেরা করা অঞ্চল। ২০২৪ সালে এখানে এসেছেন মাত্র ১.৮ লাখ বিদেশি, যেখানে শুধু বার্সেলোনাতেই ১.৫৫ কোটি পর্যটক ভিড় করেছেন।

লা রিওহা মূলত বিখ্যাত এর ওয়াইন বা মদের জন্য। এখানে ৫০০টির বেশি ওয়াইনারি রয়েছে যেখানে Tempranillo, Garnacha, Mazuelo ও Graciano জাতের আঙ্গুর উৎপন্ন হয়। বিখ্যাত Frank Gehry ডিজাইন করেছেন Marqués de Riscal ওয়াইনারি ও হোটেলের ভবন, যা আর্কিটেকচারের এক অনন্য নিদর্শন।

হারো ও লগরোনিও— দুটি মধ্যযুগীয় শহরে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন গির্জা, পাথুরে রাস্তা আর জমজমাট ট্যাপাস বার। স্থানীয় খাবার যেমন ভিন শাখায় রান্না করা মেষের মাংসের চপ এবং “পাপাটাস আ লা রিওহানা” একেবারেই আলাদা স্বাদ নিয়ে হাজির হয়।

এছাড়াও রয়েছে ৬ষ্ঠ শতকে প্রতিষ্ঠিত সান মিলান দে ইউসো ও সুসো রোমানেস্ক মঠদ্বয়, দর্শনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য, আর ঐতিহাসিক ওয়াইন উৎসব — “বাতালা দেল ভিনো” বা মদের যুদ্ধ, যেখানে হাজারো মানুষ একে অপরের গায়ে ঢেলে দেয় ৫০,০০০ লিটার লাল মদ।

এক্সত্রেমাদুরা: ইতিহাসের ভান্ডার, তবুও উপেক্ষিত

পশ্চিম স্পেনে অবস্থিত এক্সত্রেমাদুরা অঞ্চল এখনও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের নজরে আসেনি, অথচ এখানে রয়েছে তিনটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট — কাসেরেস, মেরিদা ও গুয়াদালুপে। এখানকার মনফ্রাগু জাতীয় উদ্যান পাখিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গ।

“গেম অব থ্রোনস” সিরিজের শ্যুটিংও হয়েছে এখানকার ত্রুজিলো ও কাসেরেসে, তবে এখানকার পর্যটন এখনও বেশ শান্ত। রোমান নিদর্শন দেখতে চাইলে মেরিদার চাইতে ভালো আর কোনো শহর নেই। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় প্রাচীন রোমান থিয়েটারে হয় ক্লাসিকাল নাটকের পরিবেশনা।

কাসেরেসের মধ্যযুগীয় প্রাচীরঘেরা শহরে একদিকে যেমন আছে তিনতারা মিশেলিন রেস্টুরেন্ট Atrio, অন্যদিকে ছড়িয়ে আছে স্থানীয় ট্যাপাস বার যেখানে পাওয়া যায় ভেড়ার দুধের তৈরি বিখ্যাত চিজ Torta del Casar।

প্রতিবছর মে মাসে হয় WOMAD ফেস্টিভাল, আর আছে Helga de Alvear সমসাময়িক শিল্পকলা জাদুঘর। অঞ্চলটির ঐতিহাসিক তীর্থস্থল গুয়াদালুপে মঠ একসময় খ্রিস্টোফার কলম্বাস পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এসেছিলেন কৃতজ্ঞতা জানাতে।

উত্তরের সবুজ উপকূল: ভিড় ছাড়াই সমুদ্র উপভোগ

ভিড়ভাট্টার বাইরে শান্তিপূর্ণ সৈকতের খোঁজে? স্পেনের উত্তর উপকূল হতে পারে আপনার আদর্শ গন্তব্য। সান সেবাস্তিয়ানের মতো জনপ্রিয় শহর এড়িয়ে আপনি যেতে পারেন কান্তাব্রিয়া, আস্তুরিয়াস এবং গালিসিয়া— যেখানে রয়েছে পর্বত, জঙ্গল, আর সারি সারি নির্জন সৈকত।

এ অঞ্চলের খাবারও অনন্য। পাহাড়ি গুহায় তৈরি চিজ, বিশেষ কৌশলে ঢালা সিডার, আর সামুদ্রিক শিলায় ধরা ভয়ংকর চেহারার percebes — সবই আছে এখানে।

গালিসিয়ার Senderos Azules বা নীলপথগুলো পথিকদের জন্য এক নতুন দিগন্ত। নতুন সংযুক্ত সাতটি রুটে ঘোরা যাবে সমুদ্রতট, নদীতীর ও গ্রামের ভেতর দিয়ে — যা সান্টিয়াগো পথের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

এল ইয়েরো: পর্যটন নয়, প্রকৃতি আগে

কানারি দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে পশ্চিমে অবস্থিত এল ইয়েরো এখন টেকসই পর্যটনের রোল মডেল। এখানে বাইরের দেশ থেকে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। ২০২৪ সালে মাত্র ২৬,১০০ জন পর্যটক এলেও, এর মধ্যে বিদেশি ছিলেন মাত্র ৪,১০২ জন— যা প্রতিবেশী টেনেরিফের তুলনায় নগণ্য।

এখানে পাওয়া যায় অপ্রচলিত সৈকত, আগ্নেয়শিলা জমি, গভীর জঙ্গল ও ১০০ প্রজাতির স্থানীয় গাছপালা ও প্রাণী। দ্বীপটি পুরোপুরি নবায়নযোগ্য শক্তিতে চলার পথে, এবং স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য ইউরোপে অন্যতম সেরা।

তেরুয়েল: সময় যেন এখানে থেমে গেছে

বার্সেলোনা বা ভ্যালেন্সিয়া থেকে অন্তত চার ঘণ্টা দূরের তেরুয়েল অঞ্চলের মানুষ এতটাই অবহেলিত বোধ করত যে “তেরুয়েল এক্সিস্তে” নামে একটি রাজনৈতিক দলই গড়ে ফেলে, যা ২০১৯ সালে সংসদে পৌঁছে।

এখানে নেই ট্রেনলাইন, তবে আছে অদ্ভুত সৌন্দর্যের শহর, জলপ্রপাত, প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরের পায়ের ছাপ, আর বুনো ঝরনায় স্নানের সুযোগ। আলাসডেয়ার গ্রান্ট এই অঞ্চলেই এক পুরনো দুর্গকে রূপান্তর করেছেন বিলাসবহুল প্রকৃতি রিসোর্টে।

তিনি বলেন, “এখানে বিদেশি পর্যটক এখনো ‘নতুন’ হিসেবে স্বাগত পান। পর্যটন দরকার এখানে— এবং আপনি চাইলে পুরোটা একা উপভোগ করতে পারেন।”

Jahan

×