
আপনি কি একটু শব্দ, আলো কিংবা নড়াচড়াতেই ঘুম ভেঙে ওঠেন? সহজে ঘুম ভাঙে, কিন্তু ঘুমাতে সময় লাগে?তাহলে আপনি ‘হালকা ঘুমের’ ভুক্তভোগী হতে পারেন। ঘুমের এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের গভীরভাবে ঘুমাতে অসুবিধা হয়, ফলে ঘন ঘন জেগে উঠেন এবং দিনের বেলায় ক্লান্তি, মনঃসংযোগে ঘাটতি বা মেজাজ খারাপ হওয়ার মতো সমস্যায় ভোগেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হালকা ঘুমের কারণ এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে অনিদ্রা, হরমোনের তারতম্য, জিনগত পার্থক্য এবং জীবনযাপনের ধরন এই সমস্যার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক যে কেউ এই সমস্যার শিকার হতে পারেন।
চলুন জেনে নিই হালকা ঘুম কী, কেন হয় এবং ভালো ঘুমের জন্য আপনি কী কী করতে পারেন।
হালকা ঘুম বনাম গভীর ঘুম: পার্থক্য কোথায়?
যারা গভীর ঘুমে যান, তাদের ঘুম সহজে ভাঙে না এবং তারা অনেক সময় ঘুম থেকে উঠে কাহিলভাব অনুভব করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, গভীর ঘুমের সময় ‘স্লিপ স্পিন্ডল’ নামক মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট একধরনের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়, যা বাইরের শব্দ বা আলো থেকে ঘুমকে সুরক্ষা দেয়।
অন্যদিকে, হালকা ঘুমে এই ‘স্লিপ স্পিন্ডল’-এর পরিমাণ কম থাকে, ফলে সামান্য আওয়াজ বা আলোই ঘুম ভাঙিয়ে দিতে পারে।
ঘুম ভালো করতে যা করতে পারেন
হালকা ঘুমের কারণে দীর্ঘদিন ঘুমের ঘাটতি হলে তা বিষণ্নতা, হৃদরোগ এমনকি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে কিছু নিয়ম মানলে ঘুমের মান অনেকটাই উন্নত করা সম্ভব।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ঘুমান ও উঠুন
ঘুমের রুটিন ঠিক রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম প্রয়োজন। ঘুমের সময় এবং জেগে ওঠার সময় প্রতিদিন একই রাখলে ঘুমের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় থাকে।
ঘুমের আগে শরীর ও মনকে শান্ত করুন
রাতে ঘুমানোর আগে গরম পানিতে গোসল, হালকা সঙ্গীত শোনা, মেডিটেশন বা নিঃশ্বাসের ব্যায়াম করলে শরীর ও মন শিথিল হয়, যা ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে।
আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করুন
শোবার ঘর যেন ঠান্ডা, নিঃশব্দ ও আরামদায়ক হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। ঘরে অতিরিক্ত আলো বা শব্দ যেন না থাকে। বিছানাটি শুধু ঘুম বা যৌন সম্পর্কে ব্যবহৃত হওয়াই ভালো।
স্ক্রিন বাদ দিন
ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভির স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন। এগুলোর নীল আলো ঘুমের হরমোন মেলাটোনিনের নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটায়।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত শরীরচর্চা করলে ঘুমের মান বাড়ে। তবে ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে তিন ঘণ্টা আগে ব্যায়াম সম্পন্ন করুন।
খাবারে সচেতনতা
রাতের খাবার যেন হালকা হয়। চা, কফি, চকোলেট বা অ্যালকোহল রাতের দিকে পরিহার করুন। এসব উপাদান ঘুম ব্যাহত করে।
হালকা ঘুমের পেছনে থাকা কারণগুলো
অনিদ্রা ও ঘুমচক্রের গোলমাল
অনেক সময় হালকা ঘুম অনিদ্রার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। অনিদ্রায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঘুমাতে যেতে বা ঘুম ধরে রাখতে সমস্যা হয়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ঘুম-জাগরণ চক্র বা সার্কাডিয়ান রিদম ঠিকমতো কাজ করে না।
জিনগত প্রভাব
ঘুমের ওপর জিনের প্রভাব রয়েছে। CLOCK, BMAL1, PERIOD ইত্যাদি জিন আমাদের শরীরের ঘুম-জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া কিছু জিন অনিদ্রার ঝুঁকিও বাড়ায়।
হরমোন ও স্নায়ুর রাসায়নিক পদার্থ
মেলাটোনিন, কর্টিসল, থাইরয়েড হরমোনসহ নানা হরমোন ঘুমের গুণমান ও সময়কে প্রভাবিত করে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু ওষুধ যেমন বিটা-ব্লকার, স্টেরয়েড, স্ট্যাটিন, স্নায়ুবিক চাপ কমানো ওষুধ বা উদ্দীপকজাতীয় ওষুধ হালকা ঘুম বা অনিদ্রার কারণ হতে পারে।
জীবনযাপন ও অভ্যাস
নিয়মিত ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ, রাতের শিফটে কাজ বা শারীরিক সক্রিয়তার অভাবও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
শিশুদের হালকা ঘুম নিয়ে করণীয়
গবেষণায় দেখা গেছে, ২ বছরের নিচের শিশুদের প্রায় ২০-৩০ শতাংশই রাতে ঘন ঘন জেগে ওঠে। এই অবস্থায় অভিভাবকদের করণীয় হলো:
ছয় মাসের বেশি সময় সন্তানকে বিছানা ভাগাভাগি না করানো
ঘর ঠান্ডা, অন্ধকার ও শান্ত রাখা
মৃদু শব্দ বা ‘হোয়াইট নয়েজ’ চালিয়ে ঘুমে সহায়তা করা
রাতে মনিটর ব্যবহার করলেও সামান্য শব্দে সাথে সাথে না উঠে অপেক্ষা করা
সকালে বাইরে হেঁটে সূর্যের আলোতে সময় কাটানো
হালকা ঘুমের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
ঘুমের ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতার কারণ হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
হৃদরোগ,উচ্চ রক্তচাপ,ডায়াবেটিস,স্থূলতা,বিষণ্নতা,কোলন ক্যানসার।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
ঘন ঘন ঘুম ভেঙে যাওয়া, দিনে কাজ বা গাড়ি চালাতে অসুবিধা, প্রচণ্ড নাক ডাকা বা ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, জেগে উঠে শরীর নাড়াতে না পারা বা হাত-পায়ে ঝিঁ ঝিঁ অনুভব হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
হালকা ঘুম অনেকের দৈনন্দিন জীবনের বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য শব্দ বা আলোতেই ঘুম ভেঙে যাওয়ার ফলে দেহ-মনে পড়ে ক্লান্তির ছাপ। তবে সময়মতো ঘুমানো, পরিমিত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং স্ট্রেস কমানোর মাধ্যমে ঘুমের মান উন্নত করা সম্ভব। যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
সূত্র:https://tinyurl.com/4zj8y3a2
আফরোজা