
হেলেনা নাজনীন জোবাঈদা একজন প্রগতিশীল ফ্যাশন ডিজাইনার, যিনি আর্ট-ইনফিউজড ডিজাইন নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশের ফ্যাশন দুনিয়ায় নিজের অবস্থান বেশ পোক্ত করেছেন। যিনি পোশাককে তার সারফেস হিসেবে গণ্য করে, আবেগ ও অনুভূতি, মানবিকতার উপকরণের মিশেলে বাংলাদেশী নিজস্ব মোটিফ ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার সামাজিক ও মানসিক সচেতনতা ফুটিয়ে তোলেন নিপুণ শৈল্পিকতায়। তার কাজের মূল বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পকর্ম ও ফ্যাশনের এক অনন্য মেলবন্ধন করা।
হেলেনা নাজনীন তার সম্প্রতি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত শিল্পকর্ম আদলে অনুপ্রাণিত ফ্যাশন ডিজাইন।
এর থিমটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- ‘বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার জনক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে অনুপ্রাণিত। তার চিত্রকর্ম, বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্র্য এবং জীবনের সংগ্রামের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছে। এই ফ্যাশন ধারণাটি জয়নুলের চিত্রকর্মের মাটি রঙা টোন, খসখসে টেক্সচার এবং দৃঢ় রেখা থেকে নেওয়া হয়েছে। পোশাকে ব্যবহৃত হবে সহজ অথচ আভিজাত্যপূর্ণ কাপড় যেমন- কটন, মসলিন ও পাট। হাতের আঁকা বা ছাপানো মোটিফে ফুটে উঠবে তার শিল্পের ছোঁয়া।
এই থিম কেবল ফ্যাশনের নয়; এটি জয়নুল আবেদিনের সংগ্রামী শিল্পীসত্তার উদ্যাপন। পোশাকগুলো তার শিল্প ও সংগ্রামের প্রতিফলন-সরল অথচ হৃদয়গ্রাহী, বিনয়ী কিন্তু চিরকালীন।
ডিজিটাল আর্ট বা গ্রাফিক্স ব্যবহার করে টি-শার্ট, জ্যাকেট এবং ড্রেস ডিজাইন করা হয়।
সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অনুষদে মহা আড়ম্বরে পালিত হলো বিখ্যাত শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১১০তম জন্মজয়ন্তী। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা ও মেলার তৃতীয় দিন দুটি ভিন্ন ধারার ফ্যাশন শোর আয়োজন করা হয়। একটি ফ্যাশন শো এ পোশাকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় ঢাকা চারুকলার ৮টি আলাদা আলাদা বিভাগকে। যেটির ভাবনা পরিকল্পনায় ছিলেন হেলেনা নাজনীন জোবাঈদা ও চারুকলার অন্যান্য শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা।
অন্য একটি ফ্যাশান শো যেখানে হেলেনা নাজনীন জোবাঈদা শিল্পাচার্যকে গুরু হিসেবে বন্দনা করে তার কিছু কাজের থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে একটি ফ্যাশন শোর মাধ্যমে তা উপস্থাপন করে, গুরুকে অর্পণ করেছেন তার হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
যেখানে তিনি শিল্পাচার্যের বিখ্যাত সব চিত্রকলার থিম ব্যবহার কিংবা চিত্রকলাকে সরাসরি পোশাকে উপস্থাপন না করে, তিনি চিত্রকলা থেকে লাইন, ফর্ম, টেক্সচার সেপ, কালার সংগ্রহ করে কখনো ভেঙেছেন পোশাকের আদলে, কখনো জুড়েছেন পোশাকের সেপ অনুযায়ী। কখনো আবার চিত্রকলার লাইনকে প্রয়োগ করেছেন পোশাকের কাটিংয়ে। কখনো চিত্রকলার বিমূর্ত গাম্ভীর্যকে রূপদান করেছেন পোশাকি অবয়বের মুন্সিয়ানা ও স্টাইলিংয়ের মাধ্যমে।
এই কালেকশন শুধু দেখতে সুন্দর নয়, এটি মানুষের আবেগ, সেই সঙ্গে নারী, সরলতা, আধুনিক ও লোকজ ফর্মকে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশেলের মাধ্যমে এক শৈল্পিক অনুভবকে প্রিন্ট, এমব্রয়ডারি, আপ সাইক্লিং, রি সাইক্লিং, ব্লক এবং হাতের শৈল্পিক রেখার প্রলেপনের মাধ্যমে তার পোশাকে উপস্থাপন করেছেন। হেলেনা নাজনীন এই কাজের মাধ্যমে মানবতা, সেই সঙ্গে তার আবেগী মনের এক মিহিন সংমিশ্রণের ছাপ অনুভূত করান পুরোটা কাজের মধ্যে।
ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনে তার কাজ জয়নুল আবেদীনের ঐতিহাসিক শিল্পকর্মগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করেছে স্পর্শকাতর আবেগী ও যুগোপযোগী উপায়ে। তার ফ্যাশন ডিজাইন- শিল্পের ভাষা, আবেগ ও ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। ফ্যাশনের মাধ্যমে সামাজিক বার্তা দেয়, যে পোশাক কেবল সাজের জন্য নয়; এটি মানুষকে সমাজের বাস্তবতা, যেমন দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং মমতা, আবেগ, এমনকি মানুষের লড়াইয়ের ও গল্প শোনায় ও অনুভব করায়।
তার কাজ বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে মানুষের হৃদয়ও বিবেকের মঞ্চে নতুনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ফ্যাশনে পোশাকে কোনো বিখ্যাত ছবির সরাসরি প্রতিস্থাপন দেখা গেলেও, হেলেনা নাজনীনের এ ধারাটি খুব বেশি চোখে পড়ে না।
তিনি তার ফ্যাশনে-ফ্যাশন ডিজাইন, শিল্পকলা এবং মানবিক আবেগকে একত্রিত করে এবং শিল্পের গভীরতা, সমাজিক ও মানসিক আবেগ এবং ঐতিহাসিক ঘটনাকে পোশাকে প্রতিফলিত করেন।
তিনি মনে করেন- বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ফ্যাশনকে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে, যাতে তার এই বিশ্বজনীন রূপ- বিশ্বকে তার কাছে ডেকে আনে।
তার এ সোশ্যাল কনসার্নড ফ্যাশন শিল্পের কালেকশন আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ইভেন্টে প্রদর্শিত হয়ে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করবে একদিন আশা রাখি।
প্যানেল