
ছবি: সংগৃহীত
বাংলার প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। এখানে ছয় ঋতুর পালাবদলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবহমানকাল ধরে বাংলার মানুষ তাদের খাদ্যসংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং স্বাস্থ্যের কথা ভেবে এবং পরিবেশ উপযোগী করে তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ঋতুতে আলাদা ধরনের শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, মাংস ও পিঠাপুলির আয়োজন হয়ে থাকে। গ্রামীণ বাংলার এই ঋতুভিত্তিক খাদ্যসংস্কৃতি আজও মানুষের মনে রসে-গন্ধে সমৃদ্ধ।
গ্রীষ্মকাল (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মূলত ফলের মৌসুম। এই সময় গাছ ভরে ওঠে আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, তেঁতুল, তরমুজ, বাঙ্গি, আনারসের মতো নানা ফল। গ্রামবাংলার মানুষ আমপাতা পুড়িয়ে আমের ভর্তা, আম-ডাল, আম-চাটনি বানায়। তরমুজ-চিনির শরবত আর কাঁচা আমের টক ডাল ছিল গ্রীষ্মের দুপুরের দারুণ আরাম।
বর্ষাকালে (আষাঢ়-শ্রাবণ) নদ-নদীতে নানা রকম দেশি মাছ পাওয়া যেত। শোল, ট্যাংরা, বোয়াল, চিংড়ি, কৈ, পুঁটি—এইসব মাছ দিয়ে সরষে ভর্তা, ঝোল, পাতলা তেতুল ডাল রান্না হতো। বর্ষার দিনে ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা আর কচু শাক ছিল অনিবার্য। পাশাপাশি চালকুমড়া, কচু, ঢেঁড়শের ভাজি ও ডাল ছিল বর্ষাকালের মুখরোচক খাবার।
শরৎ-হেমন্ত (ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক-অগ্রহায়ণ) ঋতুতে ধান কাটার সময় নতুন ধানের চাল দিয়ে হতো নবান্ন উৎসব। ঘরে ঘরে নতুন চালের পায়েস, খির, পিঠা—পাটিসাপটা, ভাপা, চিতই, সেমাই, খেজুর গুড়ের সঙ্গে বানানো হতো। এই সময় বাজার ভরে উঠত কলা, পেঁপে, লাউ, শশা আর নানা শাকপাতায়। গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা আর কাঁচা লঙ্কার সুঘ্রাণে ভরা থাকত বাংলার ঘর।
শীতকালে (পৌষ-মাঘ) বাংলার খাদ্যসংস্কৃতি অন্য রকম। এই সময় হতো পিঠাপুলির আয়োজন। চালের গুঁড়া, খেজুরের গুড় আর নারকেল দিয়ে বানানো হতো সেরা পিঠা। ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা, দুধপুলি, গোলাপপিঠা, সেমাই পায়েস, ক্ষীর—এসব ছিল অবধারিত। সেইসঙ্গে শীতের দিনে খেজুরের রস, পাটালি গুড় আর চালের গুঁড়ার মুড়ি বা খৈভাজা ছিল জনপ্রিয়। শীতের সকালে খেজুরের রসের ভাত বা ‘লাল চিড়া-গুড়’ ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে পাওয়া যেত।
বসন্তকালে (ফাল্গুন-চৈত্র) প্রকৃতি সাজে নতুন পাতায়, ফুলে। এই সময়ে নানা রকম মৌসুমি তরকারি যেমন বেগুন, শিম, গাজর, টমেটো, শালগম, মূলা, পালংশাক, লাউ পাওয়া যেত। বিশেষ করে চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে ‘পান্তা ভাত, ইলিশ ভাজা, কাঁচা পেঁয়াজ, আলু ভর্তা’ ছিল এক অনন্য আয়োজনে ভরা। বসন্তের উৎসবে মিষ্টির ব্যবস্থা থাকত—ছানার সন্দেশ, নারকেলের লাড্ডু। ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস মূলত মানুষের শরীরের সঙ্গে প্রকৃতির মেলবন্ধন। গ্রীষ্মে ঠাণ্ডা শরবত ও টক-ঝাল খাবার, বর্ষায় হজমে সহায়ক হালকা তেতুলডাল বা মাছের ঝোল, শীতে পুষ্টিকর পিঠা ও রসের আয়োজন, বসন্তে শাকসবজির মিশ্র রান্না—এসব ছিল সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত।
গ্রামীণ সমাজে উৎসব-অনুষ্ঠান, ধান কাটার উৎসব, নবান্ন বা পৌষসংক্রান্তির দিনেও খাদ্যের আয়োজন হতো ঋতুভিত্তিক। পিঠা-পুলি উৎসব, মাছভাতের ভোজন, ফলের মেলা, নৌকাবাইচের সময় মজাদার খিচুড়ি, সিদল ভর্তা, চালকুমড়া ভাজি—এসব ছিল লোকজ খাদ্যসংস্কৃতির অংশ। বর্তমানে আধুনিকতা আর ফাস্টফুডের প্রবণতায় এই ঋতুভিত্তিক খাবার সংস্কৃতি কিছুটা হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো গ্রামে-গঞ্জে, বিশেষ দিন বা উৎসবে সেই ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন দেখা যায়। এমনকি শহরের রেস্তোরাঁতেও এখন ‘পিঠা উৎসব’, ‘নবান্ন উৎসব’ আয়োজন হচ্ছে। বাংলার ঋতুভিত্তিক খাদ্যসংস্কৃতি শুধু স্বাদের বিষয় নয়, এটি আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই স্বাদ, গন্ধ আর রীতিনীতি টিকিয়ে রাখা দরকার।
লেখক: সোহাইল আহমেদ
কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক
আসিফ