ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ জুন ২০২৪, ২ আষাঢ় ১৪৩১

হার না মানা লিলি বেগম

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:৩০, ২৪ মে ২০২৪

হার না মানা লিলি বেগম

লিলি বেগম

দেশ এখন উন্নয়নের গতিপ্রবাহে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজের অবধারিত ও অবিচ্ছিন্ন অংশ নারীরাও কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকছে না। সীমাবদ্ধ পারিবারিক আঙিনা থেকে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা আজ সাবলীল, অবারিত এবং স্বচ্ছন্দ্য। ঘর থেকে বাইরে আসাই শুধু নয় হরেক কর্মযোগে সম্পৃক্ত হওয়াও পরিস্থিতির অপরিহার্যতা।

কয়েক বছর আগেও চাকরির ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষকতাই ছিল উত্তম পেশা। আর ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের পিছিয়ে পড়া সহনীয় বিষয় তো বটেই। যুগ ও সময়ের অনিবার্যতায় ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে অংশীদারিত্বের প্রয়োজনে সমসংখ্যক নারীরা বিভিন্নভাবে নিজেদের প্রমাণ করে যাচ্ছে। সংগত কারণে ব্যবসায়িক আঙিনায় পদচারণা ছাড়াও বৈচিত্র্যময় পেশাকে বেছে নিতে পেছনে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। লিলি বেগম একজন লড়াকু নারী।

জীবনটা সহজ, স্বাভাবিকভাবে না চলাটা প্রথম অনুভব করলেন বিয়ের পিঁড়িতে বসেই। তার আগে পিতা-মাতার কাছে বড় হওয়ার চিত্রটা অনেকটা সহনীয় এবং স্বাচ্ছন্দ্য। ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম নেওয়া লিলির শৈশব-কৈশোর কেটেছে আনন্দ আর পারিবারিক নির্মল আবহে। বাবা শেখ শাহেদ আলি, মা কুলসুম বেগম ২ ভাই ও ৪ বোনের ভরা সংসারে লিলির সে সময়কার যাপিত জীবন ছিল নানামাত্রিক আনন্দ-বেদনার টানাপোড়নে।

বাবা ছিলেন ঢাকার প্রেস ক্লাবের নৈশ প্রহরী। সামান্য বেতনের চাকরি করতেন। সংগত কারণে মাকেও কষ্ট করতে হয় অন্যের বাড়িতে কাজ করে। অর্থের প্রাচুর্য কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যের বাহুল্য ছাড়াই বাবা-মার স্নেহাতিসহ্য এবং ভাই বোনের খুনসুটি আর আন্তরিকতার নির্মল পরিবেশ ছিল এক অনন্য পাওয়া তো বটেই। তবে ১২ বছরের বালিকা লিলিকে বিয়ে দিতে তোড়জোড় শুরু করাও মনের নিভৃতে গেঁথে আছে।

বিয়ে তো নয় যেন অনাবশ্যক এক দুর্ভোগ। বড় বোনের জন্য ঠিক করা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হয়ে যায় লিলির। তার প্রচ- আপত্তি সত্ত্বেও। মেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছা ধোপেও টেকে না। সেটা প্রথম শুরু হয় বাবা-মার কাছ থেকেই। যাই হোক অপছন্দের মানুষকে বিয়ে করে সংসার পাতলেন বটে। তবে সুখের মুখ না দেখাও সদ্য বিবাহিত এক কিশোরী জীবনের দুঃসহ পালাক্রম শুরু হওয়া। সংগত কারণে বিবাহিত জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার নেশায় মেতে ওঠাও এক বিপন্ন জীবন কথা।

বিয়েটা যখন হয় তখন অবধি শরীরে ঋতুস্রাবই আসেনি। অর্থাৎ বালিকা থেকে কিশোরীর পরম সন্ধিক্ষণ। স্পর্শকাতর বয়ঃসন্ধিকাল তো বটেই। যখন কোনো মেয়ে অনাগত জীবনের স্বপ্নজাল বুনতে বুনতে লেখাপড়াও চালিয়ে যায় পিতৃগৃহে আনন্দে আপ্যায়নে। আর লিলি তখন বিরক্তিকর সাংসারিক ঝামেলার মধ্যে সন্তান ধারণের অপেক্ষায়।

সেই বহু অনাকাক্সিক্ষত অকাল মাতৃত্ব এক সময় লিলিকে কেমন যেন ভরিয়েও দিল। পুত্র সন্তানের জন্ম ও জীবনকে নতুন কোনো পথ দেখাতে ব্যর্থ হয় বরং দাম্পত্য জীবনের চরম দুর্দশা এমন পর্যায়ে যায় বিচ্ছেদের মতো তিক্ত বিষয়ও সামনে চলে আসে। স্বামী এক কথায় ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে এবং উড়নচ-ি। সংসার ধর্মে চরম উদাসীনতায় লিলির জীবনটাও বিষাক্ত এবং অসহনীয় হয়ে ওঠে।

ফলশ্রুতিতে বাধ্য হন নিজ সিদ্ধান্তে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো কঠিন পথ বেছে নিতে। একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে আলাদা জীবন কাটানোও দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া। লেখাপড়া বিশেষ কিছু হয়নি। চাকরি পাওয়াও কষ্টকর। জীবনের টানাপোড়েনে কোনো এক সময় লিলি বেগম চাকরি পান সেন্ট্রাল হাসপাতালে। রোগী পরিচার্যাকারী হিসেবে। কাজটা ছিল এক্স-রে বিভাগে। সংশ্লিষ্ট টেবিলে রোগীর দেখভাল করা ছাড়াও এক্সরে করার মুহূর্তে সার্বক্ষণিক পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকতে হয়।

ভালোই  লাগে লিলি বেগমের মানব  সেবামূলক এমন মহৎ কর্মযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরে। একমাত্র সন্তান পুত্রকে নিয়ে লিলির ছোট্ট সংসার। ছেলের বাবার খবর নেই। সেই মায়ের একমাত্র সন্তান। ফলে ছেলের দাদার বাড়ির সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ পর্যন্ত নেই। ছেলেও একটা চাকরিতে নিয়োজিত আছে। মা-ছেলের জীবন কেটে যাচ্ছে সাধারণভাবে আর কিছুটা সুখ-শান্তিতে তো বটেই।

আর কোনো পিছু টান নেই। বাবা থেকেও নেই ছেলেটার জন্য কষ্ট হলেও মা-ই সন্তানের আশা-আকাক্সক্ষায় সর্বদা পাশে থাকছেন। প্রাচুর্যের হাতছানি ছাড়াও ছেলেকে নিয়ে কঠিন লড়াই করে লিলি বেগম এখন অনেকটা সুখ স্বাচ্ছেন্দ্যের মধ্যে যাপিত জীবন অতিবাহিত করাও অনন্য পাওয়া। জীবন যুদ্ধে হার না মানা লিলি সন্তান আর নিজেকে আজ যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন সেখানে নির্দ্বিধায় তিনি অপরাজিতা। 
অপরাজিতা প্রতিবেদক

×