ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সানিয়া সোমা রন্ধন শিল্পের উদ্যোক্তা

রমজানে গৃহিণী ও রন্ধন শিল্পীদের ব্যস্ততা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০২:০৮, ২২ মার্চ ২০২৪

রমজানে গৃহিণী ও রন্ধন শিল্পীদের ব্যস্ততা

চলছে পবিত্র রমজান মাস

চলছে পবিত্র রমজান মাস। ইবাদত বন্দেগির এমন পবিত্র মাস তার ধর্মীয় আবেদনসহ নানামাত্রিক আয়োজনেও ভিন্ন মাত্রার পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করে। সবচাইতে বেশি ব্যস্ততম সময় পার করতে হয় পরিবারের গৃহিণীদের। বাড়তি ইবাদত যেমন, তেমনি খাবারেও আসে ভিন্নমাত্রার রসনা সংযোগ। রোজার আধ্যাত্মিক চেতনায় সংশ্লিষ্ট মানুষরা যেমন নিবেদনের স্তুতিতে নিমগ্ন থাকেন, সেটাও যেন পরম সৃষ্টিকর্তার এক অবিস্মরণীয় যোগসাজশ।

রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য এক পবিত্রতম নিবেদন। প্রতিদিনের যাপিত জীবনে সংযুক্ত হয় নানামাত্রিক ভিন্নতার অবধারিত মিলনযজ্ঞ। প্রথমেই খাদ্যাভ্যাসে নতুন সময় চিহ্নিত হওয়া যেন ধর্মীয় অনুভবের সাড়া জাগানো। সকালের নাস্তা নয় কিংবা মধ্যাহ্ন ভোজনও নেই। পরিবর্তে ভোররাতে সেহরি সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারির মহা আয়োজন। অভাবনীয় আয়োজন তো বটেই। বিশেষ করে গৃহিণীদের জীবনযাত্রায় আসে চমকপ্রদ চাঞ্চল্যকর অধ্যায়। তাছাড়া ইফতারির আয়োজন বাহারি  খাবার পরিবেশন আবহমান বঙ্গ ললনার এক 
চিরায়ত গৌরব বললে বেশি নয় কিন্তু। কথা বলেছেনÑ নাজনীন বেগম

সমাজের সমসংখ্যক নারীরা সামনে জোর কদমে এগিয়ে চলা বর্তমান সময়ের এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। একসময়ের গৃহিণী নারীরা আজ সমাজ ব্যবস্থার অনুকূল আবহে নিজেদের বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত করা যেন সময়ের দাবি। পুরা কালের কন্যা, জায়া, জননীর আদলে আজ তারা সামাজিক পরিবেশে বিভিন্ন কর্মযোগে অবাধ পদচারণা হাতে গোনার অবস্থায় নেই। নারীরা শিক্ষকতা এবং চিকিৎসা সেবা ছাড়া অন্য কোনো কর্মযোগে সেভাবে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। কিন্তু যুগের চাহিদা আর সময়ের পালাক্রমে সেখানে এসেছে ভিন্নমাত্রার জোয়ার।

বিশেষ করে ব্যবসাবাণিজ্যে নারীদের অনীহা, আপত্তি আজ চলমান সামাজিক পরিবেশে অন্য মাত্রায় চলে যাওয়াও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। কথা বললাম রন্ধনশিল্পী উদ্যোক্তা সানিয়া সোমার সঙ্গে। বাণিজ্য অর্থনীতিতে নারীদের অভাবনীয় যোগসাজশ একবিংশ শতাব্দীর পরম যুগসন্ধিক্ষণ। উল্লেখ করছি ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ নারী প্রকল্পের মহা ও সাড়ম্বর আয়োজন। তার যুগপূর্তি পার হয়ে এই ব্যবসাবাণিজ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারী উদ্যোক্তার সাড়া জাগানো কর্মযোগ আজ সত্যিই নজরকাড়া। বুটিক শিল্প থেকে শুরু করে রন্ধনশিল্পসহ হরেক বাণিজ্যিক কর্মযোগ নারীদের আজ নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে। সানিয়া সোমা তেমনই এক পাকাপোক্ত রন্ধনশিল্পী। যিনি কিনা পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে হরেক গ্রাহকের মনোরঞ্জনে তার মেধা ও কর্ম সাধনাকে সম্পৃক্ত করতে পেছন ফিরে তাকাতে পর্যন্ত হয়নি। 
সানিয়া সোমার ব্যক্তিগত জীবনে হরেক প্রতিকূলতা ভর করলেও নিজেকে তৈরি করার যে দৃঢ় ইচ্ছে সেখান থেকেই আজ তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। নিজেকে তৈরি করার গল্প শুনান প্রতিবেদককে। ২০০১ সালে পিতৃহীন হন। মাধ্যমিক বোর্ড পরীক্ষার শেষ দিন আজও স্মৃতির মিনারে গেঁথে আছে। মায়ের সযতœ পরিচালনা আর অভিভাবকত্বে গড়ে ওঠা জীবনের অনন্য পালাক্রম। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। কিন্তু বাল্যবিয়ে মনে হয়নি তার।

কারণ বিয়ের পরও শিক্ষা কার্যক্রম অবারিতভাবে চালিয়ে যাওয়াও স্বামীর অপার সহযোগিতা। চাঁদপুরের কন্যা সানিয়া। আর চাঁদপুর মানেই জাতীয় মাছ রুপালি ইলিশের এক সমৃদ্ধ পীঠস্থান। তাই ইলিশের হরেক রকম রসনা খাবার তৈরিতে পারদর্শী। সেখানে মায়ের হাতে ছোঁয়া রান্না পেশাগত জীবনকে বিভিন্নভাবে ঘিরে রেখেছে। মাও খুব সুগৃহিণী আর পাকা রাঁধুনি ছিলেন। আর শিক্ষা জীবনে সরকারি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনায় ¯œাতক-¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে চটজলদি জীবনের সামনে চলার পথও নির্দ্বিধায় স্থির হয়ে যায়। আজন্ম লালিত স্বপ্ন বাস্তবের মাটিতে পা যখন রাখে চারদিকে যেন নতুন জীবনের হাতছানি পেয়ে যান। মাঝখানে বিবাহিত জীবন কোনো প্রাচীর তো তৈরি করেইনি বরং সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিতে স্বামী কোনো কার্পণ্যই করেননি। সঙ্গত কারণে আজ তিনি উদ্যোক্তার কাতারে নিজের অবস্থানকে ক্রমাগত এগিয়ে নিচ্ছেন। এখন চলছে মাহে রমজান ইবাদত বন্দেগির মাস। তাই বাহারি ইফতার তৈরি করেও নিজের ব্যবসাকে ভরিয়ে তুলছেন। শুধু ইফতারিই নয় গ্রাহকের চাহিদা মতো সেহেরিও পরিবেশন করে যাচ্ছেন। সামনে অপেক্ষা করছে বহুল প্রত্যাশিত ঈদউৎসব। তেমন উৎসব আয়োজনে রান্নায়ও আসবে বহুমাত্রিক সংযোজন। ঝাল, মিষ্টি, পোলাও, কোর্মা, রোস্ট, খাসির রেজালা, গরুর ভুনা, চিকেন ফ্রাই, জর্দ্দা, সুস্বাদু পায়েস দৃষ্টিনন্দন পুডিং ছাড়াও বাহারি পিঠে পুলির সম্ভার তো থাকছেই আগ্রহী গ্রাহকদের জন্য। 

রুশিয়া আক্তার- কর্মজীবী গৃহিণী
কথা বলছিলাম একজন মানিকগঞ্জ সদরের সমাজ সেবা উপজেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রুশিয়া আক্তারের সঙ্গে। অনন্য এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাকে প্রতিদিন নিয়মমতো অফিসে ছুটতে হয়। সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সামাল দিয়ে। সেহেরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার সকালে উঠে কর্মস্থলে যেতে হয়। এক কন্যা সন্তানের জননী রুশিয়াকে অন্যরকম খাবারের ব্যবস্থা রাখতে হয়। কন্যাটি ছোট। রোজা রাখার উপযোগীও না। সঙ্গত কারণে মেয়ের জন্য সকালের নাস্তা দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত রাখা ¯েœহময়ী মায়ের জন্য ইবাদতের মতো। আর ইফতারির আয়োজন যেন ধর্মীয় শুদ্ধ আবহের এক পবিত্রতম পরিবেশ। ইফতারি তৈরি করার মধ্যেও থাকে অনন্য আধ্যাত্ম ভাবগম্ভীরতা। মুখরোচক, সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে প্রয়োজন পড়ে ধৈর্য আর সংযমের মিলিত বোধ। সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারি খাওয়ার ব্যাপার তো থাকেই সঙ্গে যুক্ত হয় তৈরি করার এক অভাবনীয় ইচ্ছেশক্তি। সামনে ভোজন রসনার সামগ্রিক আবেদন সাজানো গোছানো। কিন্তু ইফতারির আগ পর্যন্ত যতœ করে শুধু বানানো আর কোনো দিকেই নজর থাকে না। শুধু কি পারিবারিক আবহে ইফতারির এমন নজরকাড়া উপস্থাপন। তার চেয়েও বেশি গরিব, দুঃখীদের ইফতারি করানো যেন দায়বদ্ধতায় রূপ নেয়। প্রতিবেশী আর স্বজনদের কাছে বাহারি ইফতারি তৈরি করে পাঠানো আজও আধুনিকতার বলয়েও নিমগ্ন করে রেখেছে। সেটা কিন্তু কখনোই একতরফা ছিল না। পারস্পরিক মিলন গ্রন্থিতে বরাবরই তা সম্প্রীতির অনন্য নজির। শুধু কি সম্প্রীতি? উৎসবপ্রিয় জাতি হিসেবে বাঙালির যে অনমনীয় বোধ সেই প্রযুক্তির মহাসমারোহেও সংশ্লিষ্টরা বহন করে চলেছেন, আর বঙ্গ রমণীরা তো দশভূজায় সবকিছু সামলানোর এক অভাবনীয় দীপ্তি। বাহারি ইফতার সামগ্রী উপভোগ করার পর তা সামলানো গোছানোও এক আবশ্যকীয় কর্মযোগ। যা শুধু সাহায্যকারীর ওপর নির্ভর করলে চলে না। দক্ষ গৃহিণীকে স্বহস্তে সুচারুভাবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখাও বিশেষ পারদর্শিতা। আবার তিনি যদি হন কর্মজীবী তাহলে দু’হাতে পরিপাটিভাবে অফিস, সংসার, ধর্মীয় আয়োজন সবই আয়ত্তে আনা সত্যিই আবহমান বাঙালি নারীর এক অনির্বাণ শৌর্য। তারপরও কোনো ক্লান্তি শ্রান্তি ব্যতিরেকে নিরলসভাবে পরিবার আর কর্মজীবন দু’হাতে সামলানোর যে অপার সক্ষমতা তার তুলনা তো শুধু চিরায়ত বঙ্গ ললনারা নিজেই। আবার ইবাদত বন্দেগিতে নিজেকে নিমগ্নও রাখতে হয়। 
বিশ রাকাত তারাবির নামাজ। অনেকে আবার কোরআন শরীফ খতম করেন এই এক মাসেই। সেহেরির পর রোজার মূল সময় শুরু হয়ে যায়। 

×