
.
তাহসিন বাড়ির ছোট মেয়ে। গ্রামে থাকে। বাবা দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। বড় তিন মেয়ের কারও বিয়েতেই উপস্থিত থাকতে পারেননি। এবার ছোট মেয়ের বিয়েতে তাই এলাহিকান্ড। আমারও এই সুযোগে গ্রামের বিয়ে দেখার শখ মিটল। কিন্তু এ কোথায় গ্রামের বিয়ে! গ্রাম আর গ্রাম নেই। হলুদের আয়োজন ছিল একেবারেই ঘরোয়া। নিজেরাই এত সুন্দর করে স্টেজ সাজিয়েছে যে, মনেই হলো না গ্রামের বিয়ে। বিয়েতে বরের জন্য আস্ত খাসি রেডি। বর এসেছে রাজার বেশে, তলোয়ার নিয়ে। শুধু ঘোড়া আর পালকি নেই। সেই ছোটবেলায় গ্রামের বিয়ে দেখেছিলাম। ঝাপসা যতটা মনে পড়ে তা থেকে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি বিয়েতে আসা মেহমানদের সাজ-পোশাক দেখে। এখন গ্রাম আর শহরে বিয়ের আয়োজন প্রায় একই। তফাৎ হচ্ছে, শহরে ব্যান্ড পার্টি বা সাউন্ড সিস্টেম থাকে। এখানে গ্রামের বউ-ঝি, খালা-চাচিরা আঞ্চলিক গান গাইছে। কনের বড় বোন মাথায় কুলা নিয়ে মেহেদি আনতে গেল, সঙ্গে আমরা সবাই। কুলায় ছিল ধান, দূর্বা, প্রদীপ, পান-সুপারি, চুন, মিষ্টি, কাঁচা হলুদ ইত্যাদি। যে গাছ থেকে মেহেদি নেওয়া হবে, সেই গাছের গোড়ায় পান-সুপারি-চুন-মিষ্টি রাখা হলো। তারপর মেহেদি তোলা হলো। ওসব খাবার গাছের মালিকের জন্য। তারপর আবার গান গাইতে গাইতে বাড়ি আসা। এবার হলুদ-মেহেদি বাটার পালা। তবে সেখানেও জায়গা করে নিয়েছে আধুনিকতা। রেডি হলুদ আর মেহেদি দিয়েই বউকে সাজানো হলো। ঐটুকুন শুধু নিয়ম পালনের জন্য।
আর বিয়ে বাড়িতে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তাতো রয়েছেই। প্রথমেই দ্বন্দ্ব শুরু হলো বউয়ের পোশাক নিয়ে। লেহেঙ্গার হাতা ছোট, মেয়ে আগেই জানিয়েছে সে ফুল হাতা পরে। তা নিয়ে শ্বশুর বাড়ির মানুষের বিশাল হৈচৈ- যা দিয়েছি তাই পরতে হবে। আমাদের বৌ আমরা যেভাবে নিব সেভাবেই যাবে। যাক, কোনোভাবে সমস্যার সমাধান হলো। এবার খাবারের পালা। বরের জন্য রান্না করা খাসি সিদ্ধ হয়নি। তারা খাবার রেখে উঠে গেল। বিশাল ঝগড়া। তবে ভালো দিক হচ্ছে তারা বউ রেখে যাবে না। বউ নিয়েই না খেয়ে চলে যাবে। এসব দ্বন্দ্ব-কলহে অনেক সময় বিয়ে ভেঙেও যায়। ফুফু হিসেবে আমি ২/১টা কথা বলেছিলাম। কিন্তু বরপক্ষের চড়া গলার কাছে আমার কথা পাত্তাই পেল না। বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম শুধু। যারা বেশি হৈচৈ করছে তারা শহুরে শিক্ষিত মানুষ। এই যুগেও কেউ এসব নিয়ে এমন হুলুস্থুল করে! কথা হচ্ছে- যে বাবা এত টাকা খরচ করে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেছেন, তিনি কি বাবুর্চিকে বলে দিয়েছেন যে, খাসি যেন সিদ্ধ না হয়? বর পক্ষ যেন খেতে না পারে সেভাবে রান্না কর? আমি দেখেছি আমার ভাই তার অসুস্থ শরীর নিয়ে সবচেয়ে ভালো জিনিসগুলোর যোগান দিয়েছেন। টাকার দিকে তাকাননি। একজন বাবা তার সবটুকু দিয়ে একটা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
পক্ষ যাই হোক, মানুষ কি করে এমন আচরণ করে! সামর্থ্য অনুযায়ী যে যার সর্বোচ্চটা করেন বা করার চেষ্টা করেন। তারপরও যারা এসব জিনিস নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহ করে, তারা মনুষ্য পর্যায়ে পড়ে কি-না সন্দেহ। অনেকেই বলে থাকেন এসব কি কাপড় দিয়েছে, কিসব কসমেটিকস দিয়েছে, সবার জন্য কিসব উপহার দিয়েছে- তারা দয়া করে ভাবুন না- ‘থাক যা দিয়েছে তাই অনেক’। খুশি হয়ে না হোক, অপর পক্ষকে খুশি করার জন্যে হলেও একবার অন্তত তাদের দেওয়া জিনিসগুলো ব্যবহার করে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। দেখুন তারা কতটা খুশি হন! এতে পারস্পরিক সম্পর্কটাও নিবিড় হয়। কে কি দিল তা না দেখে, দিয়েছে এটাই অনেক-এইটুকু ভাবুন। তাহলেই দেখবেন সব সুন্দর। চলছে বিয়ের মৌসুম। বিয়ের কেনাকাটা, অনুষ্ঠান নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততার পাশাপাশি দুইপক্ষই এই বিষয়টা নিয়ে প্রয়োজনে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিন-যেমন জিনিসই আসুক, পছন্দ না হলেও আমরা এসব বিষয় নিয়ে কোনো কটুকথা বলব না। কারা নিজেদের শুধরে নিয়েছে তা না ভেবে আপনি শুরু করুন। তাহলে অন্যরাও আপনাকে অনুসরণ করবে। একদিন দেখবেন আপনাকে দেখে আপনার এলাকার কেউ না কেউ নিজেদের শুধরে নিয়েছে।