
রহিমা খাতুন
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন কর্মযোগ আজ বিশে^র নজরকাড়া। সমসংখ্যক নারীরও সামনে চলার পথ ক্রমশই অবারিত হচ্ছে। এক সময়ের গৃহিণী ও পাকা রাঁধুনীরা কালের দুরন্ত যাত্রাপথে হরেক বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করতে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। শুধু নানামাত্রিক কর্মযোগে নিজেকে এগিয়ে নেওয়াই নয় বরং দুঃসাহসিক মনোবলে একা হাতে সংসার সামলিয়ে সন্তান মানুষ করার কৃতিত্বকেও সামনে নিয়ে আসছেন। এক অসম সাহসী নারী রহিমা খাতুন। তার লড়াকু জীবন কাহিনী গল্পের মতো শোনালেও তা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি এক সংগ্রাম। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার পাশর্^ডাঙ্গা গ্রামের অধিবাসী এই লড়াকু রহিমা।
এক সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়া রহিমার পিতা ছিলেন সেখানকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের মর্যাদায় অভিষিক্ত। সঙ্গতকারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন নির্বিঘেœ। পারিবারিক ধর্মীয় আবহকে সামলে নিয়ে। পিতা যেহেতু শিক্ষক ছিলেন শিক্ষা জীবনকে অবারিত করাও ছিল চলার পথের স্বস্তিযাত্রা। ১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া রহিমা খাতুনের সমসাময়িক প্রতিবেশ ছিল নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য তো নয়ই। ফলে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ সমাপ্ত করে শিক্ষাজীবন এগিয়ে নিতে আর তেমন কিছু করতে না পারাও সময়ের বিপরীত স্রোত। তবে ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ পিতার কাছ থেকে নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করাও এক অনন্য যাত্রাপথ।
সেই ষাটের দশকের কথা। বিংশ শতাব্দীর রক্ষণশীল যুগে। তেমন সময়ে নারী শিক্ষা অবারিত তো হয়ইনি বরং বাল্যবিয়ের আবর্তে পড়াও ছিল অসময়ের দুর্বিষহ যন্ত্রণা। রহিমা খাতুনও তেমন সামাজিক অভিশাপকে পাশ কাটাতেই পারেননি। ফলে বালিকা রহিমাকে বসতে হয় কনের সাজে বিয়ের পিঁড়িতে। বাল্যবিয়ের কবলে পড়ে ঘরণি হতে হয় পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার রাজাপুর গ্রামের আবদুস সামাদের সঙ্গে।
বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। অপরিণত বিয়ে অত্যাচারের দারুণ দুর্ভোগ তো বটেই। মাতৃত্ব যে কোনো নারীর শৌর্য, বীর্য, অহঙ্কারও। যা যে কোনো মেয়ের পরিণত জীবন ও মননবোধে চিরন্তন জিইয়ে থাকে। তা যেন শুরু হয় সেই পুতুল খেলার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ যথাথই বলেছেনÑ
ছিলি আমার পুতুল খেলায়
প্রভাতের শিব পূজার বেলায়
তোকে আমি গড়েছি আর ভেঙেছি।
রহিমা খাতুনের স্বামী একজন সুশিক্ষিত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। স্বামী আবদুস সামাদ একজন প্রকৌশলী হয়ে কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে নিতে মোটেও ভাবেননি। এমন আদর্শ কৃষকের অঞ্চলজুড়ে সুনাম ছিল একজন দক্ষ কৃষক হিসেবে। আর এদিকে রহিমা খাতুনের জীবন চলে রক্ষণশীল সমাজের চিরায়ত ধর্মীয় আবহের ঘেরাটোপে। যে সমাজে মাতৃত্বের মহিমায় কোনো নারীকে বিচার বিশ্লেষণই শুধু নয় বরং সামাজিক মানসম্মত অবস্থানেও বসিয়ে দেওয়া হয়। রহিমা খাতুনও তেমন গৌরবের অধিকারী হতে সময় নেননি। ক্রমে ক্রমে তিন পুত্র সন্তানের জননীর পদ অবস্থান পাকাপোক্তই নয় বরং গর্বিত মায়ের আসনটিও অলঙ্কৃত করলেন।
তবে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে পরিপূর্ণ মাতৃত্বের অবয়বে নিজেকে মহিমান্বিতও করলেন। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পালাক্রমে জীবনের অমৃত পাত্র পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হতে সময় নিল না। এর মধ্যেই নিদারুণ যন্ত্রণার মর্মভেদি কষ্টও পুরো জীবনকে তছনছ করে দিল। মাত্র ২৯ বছরে চার সন্তানের জননী হলেন। পরপর মাথার ওপর ভেঙে পড়ল যেন পুরো আকাশ। আকস্মিক স্বামীর মৃত্যু। জীবন সঙ্গিনীকে শেষযাত্রার জন্য তৈরি করাও এক মর্মস্পশী আখ্যান। তার ওপর সদ্য পিতাকে হারানো চার সন্তান। মুখের দিকে তাকানোই যায় না। জ্যেষ্ঠ সন্তান আবদুল হামিদের বয়স মাত্র ৯ বছর। কন্যা সন্তান সালমার বয়স মাত্র দেড় বছর।
অবোধ শিশুদের নিয়ে জীবনের দীর্ঘপথ কিভাবে পাড়ি দেবেন কোনো কূল কিনারা পর্যন্ত পাচ্ছেন না। বয়সটাও নিতান্ত অল্প। সেটাও এক প্রকার অভিশাপ তো বটেই। কচি কচি চারটা শিশু মুখ আর সদ্য স্বামীহারা রহিমা। অকূল সমুদ্রে যেন ঝাপ দেওয়ার দুরবস্থা। তবে শক্ত হাতে দুঃসাহসী মনোবলে অসহায় সন্তানদের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রহিমা যেন ঘুরে দাঁড়ালেন কঠিন কঠোর শপথে। সন্তানদের সুশিক্ষা দেওয়াই শুধু নয়Ñ মানুষের মতো গড়ে তোলাও যেন জীবনের ব্রত হয়ে যায়। কোনো দিকে ফিরে তাকাবার সুযোগ পর্যন্ত হয় না। বিপর্যস্ত হয়েছেন বারবার কিন্তু ভেঙে মুষড়ে পড়ার দুরবস্থায় কখনো যেতে হয়নি, ভেতরে জিইয়ে থাকা অদম্য মনোবল সন্তানদের জন্য ঠিকরে বের হয়ে আসত। অন্ধকারের গহিন পথ মুহূর্তে আলোর ঝলকানিতে দিশারি হয়ে যেত।
এখন ভাবলে অবাক বিস্ময়ে পেছন ফিরে তাকান, স্বামীর অসমাপ্ত ফেলে যাওয়া কৃষিকাজের হালও ধরেছেন নির্দ্বিধায়, নির্বিঘেœ। মাঝে মধ্যে বাড়তি উপার্জনেরও প্রয়োজন হয়েছে। সেটাই সেরেছেন নিজের ছোট্ট গৃহের আঙিনায়। ঘরে বসে টুপি বানাতেন। হাতের কারুকার্যের সেলাইয়ে আকর্ষণীয় শিল্পসম্মত পণ্য তৈরি করে ঘরে বসেই ব্যবসাবাণিজ্যের পসরা খুলে বসেন সীমিত আকারে। সময়ে, প্রয়োজনে তা বাড়ানোও হতো। এই সফল মায়ের দুই সন্তানই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবনের পাঠ সমাপ্ত করেন। আরেক ছেলে ঢাকা কলেজ থেকে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মহান পাদপীঠ তো বটেই। যা একজন লড়াকু মা সন্তানদের জন্য অবারিত করলেন। কন্যা সন্তানটিকেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠা দিতে পিছপা হননি। চার সন্তানই শিক্ষায় ও পেশায় সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।