ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

মাছে ভাতে বাঙালি

দেশীয় মাছ রক্ষায় সাফল্য: চাষ হচ্ছে ১২ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছ!

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ৪ মে ২০২৫; আপডেট: ০৯:২০, ৪ মে ২০২৫

দেশীয় মাছ রক্ষায় সাফল্য: চাষ হচ্ছে ১২ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছ!

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ

নদী নালা ও খালবিলে দেশীয় ছোট মাছের জুড়ি ছিল প্রচুর। গরম ভাতের সঙ্গে ছোট মাছের চরচরির তৃপ্তির ঢেকুর ছিল ঘরে ঘরে। বিশেষ করে মানবদেহের জন্য রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এই মাছগুলো ছিল পছন্দের তালিকায় শীর্ষে।  কিন্তু কালের সাক্ষী সেই ছোট মাছগুলো বিপন্ন হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে দেশীয় মাছ প্রাণিজ পুষ্টির প্রধান উৎস। দেশীয় মাছ অন্য মাছের তুলনায় অনেক সুস্বাদু। এ সব মাছের চাহিদা সব সময় বেশি থাকে। কিন্তু অতি আহরণ এবং জলজ বিপর্যয়সহ নানাবিধ কারণে আমাদের অনেক প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তপ্রায়। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র নিরসন, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হতে হবে। গ্রামীণ জনপদের উন্নয়ন আমাদের জলাশয়গুলোকে ভরাট করে ফেলেছে। যার ফলে দেশীয় মাছের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এ ছাড়াও ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় কীটনাশকের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে দেশীয় মাছের উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যা আর আমাদের গ্রামের হাটবাজারে দেখা যায় না।

তবে এ সকল মাছ পুনরায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।  বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তালিকায় বিলুপ্ত প্রজাতির ২৬১টি মাছের নাম উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে ৬৪টি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত যা আমাদের নদী-নালা থেকে হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত প্রজাতি থেকে ৪১টি মাছের প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে নিজেদের গবেষণাগারে। এ কেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের প্রযুক্তি নির্ণয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। এ কেন্দ্র থেকে এরই মধ্যে ১২টি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ উদ্ভাবন করে চাষি পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে- টেংরা, লইট্টা বৈরালি, খলিশা, গুতুম, বালাচাটা, নাটুয়া, আক্সগুশ, কোরমা, জারুয়া, নারকেলি চেলা ও গোটালি মাছ।এমন এক বিপন্ন ছোট মাছ গোটালি। এটি অঞ্চলভেদে কালাবাটা নামেও পরিচিত। যা আজকাল পাতে উঠেনা। কিন্তু দীর্ঘদিন পর এই মাছ পাতে উঠার দুয়ার খুলেছে।  এক সময় তিস্তা, আত্রাই, সোমেশ্বরী, কংস, পিয়াইন, পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে এ মাছের সহজলভ্যতা ছিল।

২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ মাছটিকে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। সেই হারিয়ে যাওয়া দেশীয় প্রজাতির বিপন্ন গোটালি মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) নীলফামারীর সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের একদল গবেষক। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বিএফআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলী। গবেষক দলে আরও ছিলেন- ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোনিয়া শারমীন, মালিহা হোসেন মৌ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শ্রীবাস কুমার সাহা। সংশ্লিষ্টরা জানান, গোটালি মাছ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০২৩ সালে বিএফআরআইয়ের স্বাদু পানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুরের বিজ্ঞানীরা নীলফামারীর তিস্তা নদীর ডালিয়া ব্যারেজ সংলগ্ন এলাকা থেকে মাছটি সংগ্রহ করে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন। দীর্ঘ গবেষণার পর ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়।

নীলফামারীর সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ বলেন, আমরা খুবই আনন্দিত। বাঙালির পাতে আবার ফিরিয়ে আনতে পেরেছি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ। তিনি গোটালি মাছের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলেন, মাছটি অত্যন্ত স্বাদ ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ। মাছটির মাথা চ্যাপ্টা ও শরীর লম্বা আকৃতির। সমবয়সি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছের চেয়ে আকারে বড় হয়। মাছটির দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১৫ থেকে ১৭ গ্রাম হয়ে হয়ে থাকে। মাছটির প্রজননকাল জুন থেকে জুলাই মাস।

সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলী বলেন, চলতি মাসে আমাদের গবেষণাকে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহ গবেষণার স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে মাছটি চাষি পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ফলে এ মাছ খাল-বিল ও নদী-নালায় সহজে মিলবে।তিনি বলেন, গোটালি মাছে ইনজেকশন প্রয়োগ করার ৭-৮ ঘণ্টা পর স্ত্রী গোটালি ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার ৮-১০ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেণু বের হয়। ধাপে ধাপে নার্সারি হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং সঠিক পরিচর্যায় ৫০-৬০ দিনে মধ্যে আঙুলি পোনায় পরিণত হয়।   তিনি আরও জানান, গোটালি মাছের কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে এ মাছের চাষ সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে, যা দেশের মৎস্য খাতে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মৎস্য চাষিদের জন্য এটি একটি আশার বার্তা। এ উদ্যোগ গোটালি মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে রা করবে এবং বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের মৎস্য স¤পদ উন্নয়নে জাতীয় চাহিদার নিরিখে নিয়মিত গবেষণা পরিচালনা ও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের মিঠা পানির মৎস্য স¤পদের সার্বিক উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অনেকগুলো  মৌলিক ও প্রয়োগিক গবেষণা পরিচালনা করেছে। গ্রামীণ জনপদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় স্বল্প ব্যয়ে অপেক্ষাকৃত কম শ্রমনির্ভর এবং পরিবেশ উপযোগী অধিক ফলনশীল  সুস্বাদু উন্নত জাতের  মাছ চাষের কৌশল উদ্ভাবন করছে। অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ভাবিত এ সকল প্রযুক্তি প্রান্তিক পর্যায়ের অগ্রসরমাণ চাষিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাদের নানারকম প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে হাতেকলমে দক্ষতা করে গড়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের মৎস্য চাষিরা মাছের  জাত উন্নয়ন, জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনা কৌশল আয়ত্ত করে দেশীয় মিঠা পানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইনস্টিটিউটের সদর দপ্তর ময়মনসিংহে অবস্থিত। জলজ পরিবেশ ও মৎস্য সম্পদের প্রকৃতি বিবেচনায় ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত ৫টি কেন্দ্র এবং ৫টি উপকেন্দ্র থেকে পরিচিত হয়ে থাকে। এগুলো হলো- স্বাদু পানি কেন্দ্র, ময়মনসিংহ, নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর, লোনাপানি কেন্দ্র, পাইকগাছা, খুলনা, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজার এবং চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র, বাগেরহাট। এছাড়াও উপকেন্দ্র ৫ টি হচ্ছে নদী উপকেন্দ্র, রাঙ্গামাটি,প্লাবন ভ‚মি উপকেন্দ্র, সান্তাহার, বগুড়া, স্বাদু পানি উপকেন্দ্র, যশোর, নদী উপকেন্দ্র, কলাপাড়া, পটুয়াখালী এবং সাদু পানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুর,নীলফামারী। ইন্সটিটিউট দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করে এ পর্যন্ত মোট ৭৫ টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে।
সূত্র মতে দেশে কম বেশি ১৩ লাখের মতো দীঘি, পুকুর, খাল বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয় রয়েছে। এসব জলাশয়ে সনাতন পদ্ধতিতে মাছের চাষ হওয়ায় উৎপাদন কম হয়। অথচ পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাছ চাষ করা হলে কয়েকগুণ বেশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সাথে সাথে আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য অধিক হারে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অধিকাংশই ছোট মাছ। ছোটো মাছের সুবিধা হলো এসব মাছে ভিটামিন-এ ও ডি,ক্যালসিয়াম, ফসফরাস,  আয়রন ও আয়োডিন থাকে। যার ফলে মানবদেহের হাড়,দাঁত, চর্মরোগসহ রক্তশূন্যতা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। আমাদের দেশে প্রতিবছর কম বেশি ৩০ হাজার শিশু রাত কাণা রোগে আক্রান্ত হয়। এটি আয়োডিনের অভাবে হয়। ছোটো মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে ফলে নিয়মিত ছোট মাছ খেলে রাতকানা রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দেশের মৎস্যসম্পদ খাতে সরকারের মৎস্যবান্ধব নীতিগ্রহণ ও চাহিদাভিত্তিক টেকসই কারিগরি পরিষেবা প্রদানের ফলে মৎস্য উৎপাদন বাড়ছে। 

ফারুক

×