
ডেঙ্গু
ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। সাধারণত আক্রান্ত রোগী শরীরে উচ্চমাত্রার জ্বর, মেরুদণ্ড ও অন্যান্য জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে গুরুতর ব্যথা অনুভব করে। ভয়াবহ (severe) ডেঙ্গু হলে রোগী ব্লিডিং বা রক্তক্ষরণ অথবা শকে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। যদিও ভাইরাসটি প্রাথমিকভাবে ইমিউন সিস্টেমকে আক্রমণ করে, তবে কখনো কখনো এটি হার্ট বা হৃদপিণ্ডের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের সাথে সম্পর্কিত কার্ডিয়াক বা হৃদপিণ্ডের জটিলতাগুলির মধ্যে একটি হল মায়োকার্ডাইটিস বা হৃৎপিণ্ডের পেশীর প্রদাহ। এই ভাইরাস সরাসরি হার্টের কোষকে সংক্রমিত করতে পারে, যার ফলে মায়োকার্ডিয়াল বা হৃদপিন্ড পেশির কোষের ক্ষতি হয়। এর ফলে বুকে ব্যথা, ধড়ফড়, এমনকি গুরুতর ক্ষেত্রে হার্ট ফেইলিউরের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাছাড়া ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম, যা এই রোগের একটি গুরুতর রূপ, দেখা দিলে শরীরের রক্তচাপ অত্যধিক কমে গিয়ে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে হৃৎপিণ্ডেও রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে, যা হৃদপিণ্ডের কর্মক্ষমতাকে আরও সংকুচিত করতে পারে। এই চক্রে আবদ্ধ রোগীদের বেশিরভাগই বেঁচে ফিরতে পারে না। তাছাড়া ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের হৃদপিণ্ডে অ্যারিদমিয়া বা অনিয়মিত সংকোচন এবং পেরিকার্ডাইটিস (হৃদপিণ্ডের চারপাশে পর্দার প্রদাহ) দেখা দিতে পারে, যার ফলে বুকে ব্যথা এবং সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী জটিলতায় ভুগতে হতে পারে।
হৃদপিণ্ডের উপরে ডেঙ্গুর এই প্রভাবগুলি অবিলম্বে চিহ্নিত করে তার চিকিৎসা করা অপরিহার্য। রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখার জন্য শিরায় আইভি স্যালাইন দিতে হতে পারে। রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করা লাগতে পারে এবং ডোপামিন জাতীয় আইনোট্রোপ ওষুধের প্রয়োগ করা লাগতে পারে। এক্ষেত্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং যত্ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু জ্বর থেকে সেরে ওঠা রোগীদেরকেও হৃদরোগের জন্য মূল্যায়ন করা উচিত যাতে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা না দেয়।
যখন একজন কার্ডিয়াক রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়, তখন এটি তাদের বিদ্যমান হার্টের রোগকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে এবং গুরুতর জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যারা আগে থেকেই হার্টের রোগে ভুগছিলেন তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তাদের অবস্থা অনেক বেশি গুরুতর হতে পারে। বিশেষজ্ঞগন এজন্য প্রধানত তিনটি কারন চিহ্নিত করেছেন :
প্রথমত, ডেঙ্গুর উচ্চমাত্রার জ্বর এবং ক্ষুধামন্দা থেকে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হৃৎপিণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এধরণের রোগীদের আগে থেকেই কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের সক্ষমতায় ঘাটতি থাকে। তদুপরি তাদের উচ্চমাত্রার জ্বর এবং এর সাথে পানি বা রক্তশুন্যতা যোগ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এর ফলে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের অন্যান্য উপসর্গের দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু জ্বরে থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বা রক্তের প্লেটলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা কমে যেতে পারে। হৃদরোগীরা প্রায়ই রক্ত-পাতলা রাখার ওষুধ সেবন করে থাকে, যেমন এস্পিরিন, ক্লোপিডগ্রেল ইত্যাদি। কোন কোন হৃদরোগে হেপারিন ও স্ট্রেপ্টোকাইনেজ ইঞ্জেকশন দেওয়া লাগতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর হার্ট এটাক বা হৃদরোগ হলেও এসব ইঞ্জেকশন ব্যবহার করা যায় না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তাদের রক্তপাতের ঝুঁকি এমনি বেড়ে যায়, এসব ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করলে ভয়াবহ রক্তক্ষরণ হয়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এরকম রোগীদেরকে অবশ্যই ভালো হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করা আবশ্যক। তাছাড়া চলমান ওষুধ বন্ধ বা পরিবর্তন করতে গেলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
তৃতীয়ত, মারাত্মক ডেঙ্গু, যা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম নামে পরিচিত, তাতে রোগীর শক হয়ে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে রক্ত, পুষ্টি ও অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে। ডেঙ্গুর এই মারাত্মক রূপটি হৃদপিন্ডকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, বিশেষ করে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে যারা আগে থেকেই কার্ডিয়াক বা হৃদরোগে ভুগছিলেন।
ডা: এস এম ইয়ার ই মাহাবুব
সহযোগী অধ্যাপক
ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজি
বিএসএমএমইউ
সেতু/এস