ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ

তাসমিম সুলতানা

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ২৪ মার্চ ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ

জাহানারা ইমাম ও শিশির বানু মিতিল

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই-ই সর্বাত্মক এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল সমানভাবে। ২৫ মার্চের কালরাতের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন পুরো বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে, সেই সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করতে সচেষ্ট থেকেছেন, করেছেনও। এই বাস্তবতায় খানসেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছে বিপন্ন নারী-শিশুর দল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চষে বেড়িয়েছে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।

সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বাছবিচারহীনভাবে। নারীরা ধর্ষিত বা অত্যাচারিত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা যেমন বড় হয়ে উঠেছে, তার চেয়েও বড় সত্য এই যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারী সমাজ লড়াই করেছে, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে। এ ক্ষেত্রে কেবল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নয়, বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, যে কোনো অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ অথবা স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর অবদান কোনো অংশেই কম নয়। 
যে কারণে একজন বিথীকা বিশ্বাস বা শিশির কণা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের গানবোট গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধশেষে তাদের ললাটে জোটে সামাজিক লাঞ্ছনা। এই বিথীকা বিশ্বাস ও শিশির কণাকে তাদের পরিবার ও সমাজ গ্রহণ করেনি। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে এমন উদাহরণ অসংখ্য। 
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন একাত্তরের জননী গ্রন্থের লেখক চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮-তে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। একাত্তরে নির্যাতনের শিকার অনেক নারীর মতো এ নারীর জীবনেরও ট্র্যাজেডি হলো, যুদ্ধের পর স্বামীগৃহে তার ঠাঁই মেলেনি। নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, এই সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে ধাপে ধাপে, যেখানে নারীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বিদ্যমান।

১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নারীরা ও ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। ১৯৬৯-এর ১৯ জানুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর লাঠিপেটা করে সামরিক জান্তার সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদুজ্জামান। এরপর শিবপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে আসাদের মা ছাত্রনেতাদের কাছে বাণী পাঠালেন, ‘আমার আসাদের মৃত্যু হয়নি। আমার আসাদ বলত, ‘মা, আগামী দশ বছরের মধ্যে এই মাতৃভূমি নতুন জীবন পাবে।’ আমার আসাদের এই স্বপ্ন তোমরা সার্থক কর।’ (দৈনিক আজাদ, ২৬ জানুয়ারি ১৯৭০)। আসাদের মায়ের এই বাণীর মধ্য দিয়ে তার যে পরিচয় আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়, তা অবশ্যই একজন মুক্তিযোদ্ধার।
সেই সময় ছাত্রীরা সব মিছিল-আন্দোলনে সোচ্চার থেকেছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারীসমাজ রাজবন্দি মুক্তি আন্দোলনে, গণ-আন্দোলনে, মিছিলে প্রতিদিনই যোগ দিয়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯-এ এই মহীয়সীর নেতৃত্বে সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আড়াই হাজার নারী সমাবেশ করেন, মিছিল করে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যান। ২৪ মার্চ ১৯৬৯-এ প্রকাশিত আজাদের তথ্য অনুযায়ী, বোরকা পরা হাজার হাজার পর্দানশিন নারীও যোগ দেন সেই মিছিলে।

একাত্তরের উত্তাল মার্চের ৭ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঘোষণা দিলেন, ‘আর যদি একটি গুলি চলে প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, সেই সময়েও ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন নারীরা। ফলে দেখা যাবে, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, ঈশ্বরদী, পাবনা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ সব জেলায় নারী সমাজের প্রতিবাদী সভা ও মিছিল হয়েছে।

এ সময় তারা জেলায়, শহরে-শহরে, এলাকায়-এলাকায় সংগঠিত হয়ে কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র চালনার ট্রেনিংও শুরু করে। ৯ মার্চ বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। এই কাজে নারীসমাজ ও ছাত্রসমাজ প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। (জহিরুল ইসলাম, একাত্তরের গেরিলা, ঢাকা, প্রকাশক মিলন নাথ, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা.২০)।
পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বহুমাত্রিকভাবে নারীরা সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মের নারীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কলকাতায় রাজনীতবিদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পের ৩০০ তরুণীকে গোবরা ও ‘বিএলএফ’ ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এঁদের মধ্যে গীতা মজুমদার, গীতা কর, শিরিন বানু মিতিল, ডা. লাইলী পারভীন অস্ত্রচালনা শেখার পরও তাদের সম্মুখসমরে যেতে দেওয়া হয়নি। নারীদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নে সেই সময় যুদ্ধকালীন সরকারের ভেতরেই দ্বিধা ছিল।
এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের কথাও বলা দরকার। শহীদ রুমীর মা জাহানা ইমাম বা শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো সব মা-ই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। তাদের এই ত্যাগও ইতিহাসের অংশ। মূলত এভাবেই নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অদম্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যারা, তারা অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার এবং কাপড় সংগ্রহ করা রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তৎকালীন সভানেত্রী সুফিয়া কামাল পাকিস্তানি বাহিনীর নজরদারিতে যুদ্ধের ৯ মাস ঢাকায় তার বাড়িতেই ছিলেন। ওই অবস্থায়ও তিনি নানা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। এসব তিনি সে সময় দিনলিপিতে লিখেছেন, যা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। 
স্বাধীনতার ২৯ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষ অবদানের স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন নারীরা। এর ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ বিস্মৃতি ও অবহেলা শেষে ইতিহাস এখন বদলাতে শুরু করেছে। 
নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিনজন-১৯৭২ সালে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম; এরপর তারামন বিবি ১৯৭৩ সালে ও ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন কাঁকন বিবি। তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি ২০১৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন। বাঙালির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

×