ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফাগুন আসছে...

রেজা ফারুক

প্রকাশিত: ২২:৪০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ফাগুন আসছে...

.

প্রকৃতির ভাঁজে ভাঁজে যেন মন কেমন করা, উদাস আর চঞ্চল সমীরণের প্রগাঢ় উচ্ছ্বাস জাগা আবাহন। মাধবী আর বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ে রঙিন প্রজাপতি আর ফড়িঙের গুঞ্জরিত উড়া-উড়ি। প্রকৃতির যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই যেন ঝকঝকে বর্ণোজ্জ্বলতার ছোঁয়া। থেকে থেকে কোকিলের হৃদয়কাড়া কুহরণে নিসর্গের ক্যানভাসে উদ্ভাসিত হয় ঋতু বদলের অমোঘ প্রহর। যে প্রহরের সান্নিধ্যে সমগ্র চরাচরে নতুন এক ছবির উন্মেষ ঘটে। বসন্তের ওই উন্মেষের কথা মাথায় রেখেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন এক অনন্য বসন্তকালীন কবিতা। যার পঙ্ক্তিতে বসন্তের বন্দনা ঝরে পড়ে অমিয় ঐশ্বর্যে।

ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।হ্যাঁ আজ বসন্ত। আজ পহেলা ফাল্গুন। বাঙালির আঙ্গিনায় থোকা থোকা, বসন্তের আরক্তিম ছায়ার পালক যেন বিছিয়ে দিয়েছে এক উন্মাতাল আবেগের রোদ আর জ্যোৎস্নারাজি। সকালবেলার সবুজ দূর্বাঘাসে হাল্কা রৌদ্রাঙ্কিত শিশিরকুচির মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলী আর অদূরের লাল আগুনঝরা কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায় সবুজ পাতার ঝালর সরিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের সমারোহ বসন্তের আগমন বার্তাকে যেন আরও প্রবলভাবে জানিয়ে দেয়।

বসন্তের দুপুরগুলো উদাসীনতায় মোড়ানো হলেও বিকেলগুলো ভীষণ উন্মুখর হয় ফুরফুরে দখিনা হাওয়ায়। চাঁদের কিরণে আবৃত বসন্তকালীন সন্ধ্যা আর রাত্রির মহিমার যেন কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা চলে না। হলুদ বসন্ত দিনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন বাঙালির জীবনধারাকে ভাবাপ্লুত করে তোলে। তাদের দৈনন্দিন জীবনেও চলে আসে বিপুল পরিবর্তন। অন্তরজুড়ে বসন্তের রঙ যে আবেগ সঞ্চার করে তার প্রভাবটাও গভীর ব্যঞ্জনায় রোজকার জীবনযাপনে প্রতিফলিত হয়। আর তার প্রকাশটা প্রগাঢ়রূপে ধরা দেয় পোশাকের মধ্য দিয়ে।

একটা সময় ছিল যখন বাসন্তী রঙের শাড়ি, রঙিন পাঞ্জাবিতেই বসন্তের ছবিটা ফুটিয়ে তোলার আবহটা চোখে পড়ত। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে বসন্তের পোশাক ঘিরে নতুন এক উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। যে উচ্ছ্বাসটা বসন্তের উৎসব আমেজকে দিয়েছে গহন ছন্দময়তা। সেটা হলো বাঙালির আবহমান, চিরন্তন সংস্কৃতিকে নান্দনিকতার শোভায় উৎকীর্ণ করে পোশাকের আদলটা আধুনিক ডিজাইনের শৈল্পিক পঙক্তিতে বুনন করে তাকে ফ্যাশনেবল করে তোলার নিবিড় প্রয়াস। নগর জীবনের নানা ব্যস্ততায় কখন যে ঋতুর বদল ঘটে তা যেন নগরবাসী জানতেই পারে না। তবে এর পরিবর্তন বেশ অনেকদিন ধরে লক্ষণীয় বাংলার ফ্যাশনধারার শিল্পীত উদ্যোগ একেবারেই পাল্টে দিয়েছে অবস্থার।

ধুলোময়, শব্দজটের নগর জীবনের প্রাণেও এনে দিয়েছে নতুন স্পন্দন। আর তাই অন্যান্য ঋতুভিত্তিক উৎসবের মতো ঋতুরাজ বসন্তকে বরণের লক্ষ্যেও ফ্যাশন ট্রেডে শীতের মাঝামাঝি সময় থেকেই চলতে থাকে ব্যাপক প্রস্তুতি।

একই প্রস্তুতি মনে মনে লালন করেন নগরবাসীও। প্রাঙ্গণে বসন্ত, তাই চলছে এখন বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার তুমুল আয়োজন। আর আয়োজনের প্রধান অনুষঙ্গ হলো বাঙালিয়ানাকে অঙ্কিত করা পোশাক। সে পোশাক হোক শাড়ি, থ্রি-পিস, ফতুয়া পাঞ্জাবি, শার্ট কিংবা টিশার্ট। সেই সঙ্গে খোপায়, গলায়, হাতে শোভা পাবে মন উতলা করা প্রাণের গাঁদা, রজনীগন্ধা, গোলাপ জুঁই। আর এই বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার আগে থেকেই চলবে শপিংমলের আউটলটগুলোতে ক্রেতাদের উৎসবমুখর যাওয়া-আসা। পছন্দের পোশাকটি পহেলা ফাল্গুনের আগেই সংগ্রহে রেখে দেওয়া যেন বসন্তের প্রথমদিনের প্রথম প্রহরে নবসাজে সেজে উৎসবে অংশ নেওয়া যায়। আর এদিকটা মাথায় রেখে ফ্যাশনটেন্ডও থাকে প্রস্তুত। বসন্তকে ঘিরে অতুলনীয় এই আয়োজন থেকে নগর জীবনের মতো পিছিয়ে নেই মফস্বল শহরগুলোও। রাজধানী ঢাকার মতো মফস্বল শহরের রঙটাও পহেলা ফাল্গুনে বাসন্তী-হলুদ লালে যেন ছেয়ে যায়। বাঙালির চিরায়ত স্বকীয়তা অক্ষুণœ রেখে সকলেই বসন্ত বরণে সমবেত হয় গভীর আগ্রহে। বসন্তের আরও একটি বিশেষত হলো- বসন্তেই ঢাকায় আয়োজিত হয় প্রাণের একুশে বইমেলা। বসন্ত এবং বইমেলা যেন নরগজীবনেরও আবেগকে পৌঁছে দেয় এবং অসীম কাব্যিকতায়।

ঋতুরাজ বসন্ত যখন রেশমি কোকিলের কোমল কণ্ঠের কারুকাজের ভাঁজে ভাঁজে বিনম্র ভালোলাগার পরশ বুলিয়ে যায়। তখন ভালোলাগার সেই স্পর্শকে অনুরণিত করে তোলে ১৪ ফেব্রুয়ারির ভালোবাসা দিবস। পৃথিবীজুড়ে এই দিনটিকে ঘিরে এক অভূতপূর্ব সংবেদনময় গুঞ্জরণ ছড়িয়ে পড়ে অন্তহীন আবেগে। নিসর্গের পল অনুপলে যখন ভালোবাসা দিবসের হৃৎস্পন্দনে বাজে এস্রাজের মায়াবি রিদম। তখন ঢাকার বাংলা একাডেমিতে শুরু হয়ে গেছে বাঙালির প্রাণের একুশে গ্রন্থমেলা। এই মেলাকে ঘিরে বাঙালির আবেগের সীমাটা ছাড়িয়ে যায় নীল দিগন্তকেও। আর এই দিগন্তের রঙটা দেশীয় ফ্যাশন ভুবনের প্রতিটি স্তবকে নতুন যাত্রায় হয় উদ্ভাসিত। ঋতুরাজ বসন্ত, ভ্যালেন্টাই ডে এবং একুশে গ্রন্থমেলার মতোত্রৈয়ীস্পন্দনে যেন প্রকৃতির উড়ুউড়ু মনটাই আজ উঠেছে ভিজে বাসন্তী রঙের জাফরানি ছোঁয়ায়!

×