
জীবনের রূপবদল নৃত্যে নিবেদন
জনকণ্ঠের ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন সমাজের কিছু সফলকাম নারী। এবারে সম্পৃক্ত হয়েছেন- ট্রান্সজেন্ডার রানী চৌধুরী। প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী এবং কর্মজীবী এই রানী চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় ছিলেন ইশরাত পায়েল। সব শুনে জানাচ্ছেন- অপরাজিতা প্রতিবেদক
কেমন আছেন?
ভাল আছি। আরও আগে তোমার সঙ্গে আমার অনেক কাজ হয়েছে। আমরা দুজনই খুব নিকটজন, ভাল বন্ধু। তোমার সঙ্গে আলাপ করাও অনেক আনন্দের ব্যাপার।
ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে পুরুষ থেকে নারী হওয়ার অনুভূতি?
অবশ্যই বেশ স্পর্শকাতর অনুভব যা প্রাকৃতিক ভাবেই শরীর ও মনকে রূপান্তরের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।
পুরুষ থেকে নারী হওয়ার জন্য কি কোন কষ্ট করতে হয়েছে?
কষ্টটা সমাজে নিজেকে যথাযথরূপে তুলে ধরতে বহু কাঠখড় পোড়ানো ছাড়াও নানামাত্রিক মানসিক যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয়েছে। এখানে একটি বার্তা না দিলেই নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক সহযোগিতা ও নজরদারিতে আমাদের মতো ট্রান্সজেন্ডারদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। সরকার প্রধানের পরিকল্পিত কিছু কর্মযোগে আমার চলার পথ অনেকটা নতুনভাবে অবারিত হয়েছে।
নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার পেছনের গল্প?
বিটিভির মাধ্যমেই আমার নৃত্যশিল্পীর পথ চলার শুভ সূচনা। রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে আমাকে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়েছে। স্বাভাবিক নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গেই ট্রান্সজেন্ডার রানীকে মোকাবেলা করা অত সহজ ছিল না। প্রতিযোগীর সংখ্যা ১০০০ জন। সবাইকে তাক লাগিয়ে ষষ্ঠ স্থানে উঠে আসাও বিরাট সফলতা। তবে পরিচিতিটা আড়ালই ছিল। পোশাকে, সাজসজ্জায় শুধু নারী ভাবতে পারাটাও বিচারকদের জন্য একটা চমক ছিল। তবে ক্রমান্বয়ে প্রকাশ হয় আসলে আমি পুরুষ থেকে রূপান্তরিত এক নারী সত্তা। পরবর্তীতে তেমন পরীক্ষায়ও সফল হই।
হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডারের ব্যবধান?
একেবারে সহজ- ঘরের আলু ভাজা আর রেস্টুরেন্টের ফ্রেন্স ফ্রাই। হিজড়াদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি, আচার আচরণ এবং সাজসজ্জা থাকে। সেভাবেই তাদের জীবনাচরণ আবর্তিত। আর ট্রান্সজেন্ডাররা অনেকটাই পরিশীলিত। যেহেতু বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের শারীরিক ও মানসিক গড়ন নতুনভাবে আবর্তিত হয় সেখানে তারা একটু ভিন্ন মাত্রার মার্জিত অবয়বে নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম।
ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার পর নামের কোন পরিবর্তন?
অবশ্যই। আগে ছিলাম মাসুদুল হক রানা। পরিবর্তিত ব্যক্তিটি হয়ে গেল রানী চৌধুরী। নতুন নাম নিয়ে কোন অসুবিধাই হয়নি। এভাবে নতুন জীবনের শুভ সূচনায় এগিয়ে চললাম।
ছেলে থেকে মেয়ে হওয়ার পর কিভাবে নিজেকে সাজাতে গোছাতে হলো...
শরীর ও মনের এক অভাবনীয় নতুন অনুভবে নিজেই সচকিত হই। তখন প্রথমেই নজর দিতে হয় পরিধেয় পোশাকের দিকে। মেয়েদের পোশাকের দিকে। মেয়েদের পোশাক পরতে শুরু করি। নারীর স্বাভাবিক ও সহজাত তাড়না যখন ভেতর থেকে উদ্দীপ্ত হতে লাগল সেটাকে আমলে নিতে মোটেও দেরি করিনি। শেষ অবধি পূর্ণাঙ্গরূপে নিজেকে নারীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করি।
তুমি দেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে সফল নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায় নিজের নাম লিখিয়েছ। সে অনুভূতি ভাগ করবে কি?
অবশ্যই। চমক, মুগ্ধতা, বিস্ময় সবই যেন একসঙ্গে শরীর ও মনে নারীর সহজাত অনুভবে নিজেই শিহরিত হলাম আনন্দ আর আবেগে। ক্রমান্বয়ে সফলভাবে নিজেকে তৈরিও করে নিই।
সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার কথা কি ভাবছ?
হ্যাঁ ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোন একসময় সুযোগ পেলে অবশ্যই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে দেব।
অপ্রাপ্তি যদি কিছু থাকে ভাগ করে নিতে পার...
না পাওয়ার কত বেদনা সব সময় তাড়িত করে। নিজেকে যোগ্য করে তোলার পরও সফলতা আনতে এখনও বার বার হোঁচট খেতে হয় যা মানা যায় না। সব মৌলিক অধিকার এখনও অর্জন করতে পারিনি। ভদ্র সমাজের বাড়িতে বেশিদিন থাকতেও পারি না। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে আমাদের মতো ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য বাড়ি বরাদ্দ করা সঙ্গত। নিজের একটা বসতভিটা থাকা খুব জরুরী এবং তা ঢাকাতেই। কারণ আমার সার্বিক কর্মযোগ রাজধানীতেই।
কিছু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছেÑ জাতীয় সংসদে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কিছু নীতিমালা প্রণয়ন শুরু হয়েছে এবং তার আইনী কার্যক্রম প্রক্রিয়াও জানা যাচ্ছে।
কথাটা সত্যিই এবং তা সরকারের বিবেচনাধীন।
তোমার নামও উঠে আসছে। সেটার সত্যতা কতখানি?
আগে কার্যক্রম শুরু হোক। তারপর অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবা যাবে।
তুমি আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। রানা থেকে রানী হতে কতখানি বিঘœতা তাড়া করেছে।
বলে শেষ করা যাবে না। রাস্তায় ঘোরাঘুরি ছাড়াও না খেয়ে দিন যাপন করার যন্ত্রণাও পোহাতে হয়েছে। কষ্টের কোন সীমা পরিসীমা ছিল না। সফলতা পেতে নিজেকে বহুবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। নিজের কোন পরিবার পরিজন নেই। একাই সামলাতে হয় সব।
নারীত্বের সঙ্গে মাতৃত্বও জড়িত। এ সব নিয়ে কোন ভাবনা?
অবশ্যই। একজন বাচ্চা লালন পালন করার ইচ্ছে ভেতরের বোধে জিইয়ে আছে। এমন সব বাচ্চা বেশিরভাগই যৌন কর্মীদের। সেখানেও আমার কোন আপত্তি নেই।
মনের মতো একজন জীবন সঙ্গী?
আমাকে জেনেশুনে যে তার কাছে নিয়ে যাবে তাকেই মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করার ইচ্ছে আছে। তেমন নিকটজনের কাছে নির্দ্বিধায় চলে যাব। কোন কল্পনা কিংবা রটনা নয়- নির্ভেজাল ভালবাসায় জীবনটাকে নতুন ও সুন্দরভাবে গড়ে নিতে চাই।
* আমাদের সবার পক্ষ থেকে তোমার জন্য তেমন শুভ কামনা থাকল।