ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

জন্মদিনের কান্না

প্রকাশিত: ১১:৫৫, ১৪ মার্চ ২০২০

জন্মদিনের কান্না

দাদুর নামে খাম এসেছে। ডাক পিয়ন দিয়ে গেছে। এই কথাগুলো তিথি কতবার যে বলল! খামের ওপরে দাদুর নাম লেখা। ছপু মিয়া। নামের পাশে লেখা- বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভেতরে দাওয়াত কার্ড তো কিছু। দাদুর নামে কখনও কোন খাম এসেছিল কি? ওর তো মনে পড়ছে না। মা-ও বলতে পারলেন না। দিদা বেঁচে থাকলে হয়ত বলতে পারতেন। ১৭ মার্চ তারিখে একটি অনুষ্ঠান হবে। সেই অনুষ্ঠানে দাদু বিশেষ অতিথি। কি অনুষ্ঠান, কেন অনুষ্ঠান ইত্যাদি হাজারও প্রশ্ন নিয়ে বাড়ির অন্যরা ঘিরে ধরেছে। তিথিকেই বলতে হচ্ছে যা বলার। কেননা, ওর হাত থেকে কার্ড কেউ নিতে পারেনি। মা-ও না। ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। জাতীয় শিশু দিবস। নানা রকমের অনুষ্ঠান হবে। তিথিদের স্কুলেও হবে। এই অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছপু মিয়া বিশেষ অতিথি। তাকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করেছেন স্কুলের হেড স্যার। হেড স্যার কি জানেন, ছপু মিয়া তিথির দাদু? মনে হয় না। হেড স্যার আসলেই জানেন না, ছপু মিয়া তিথির দাদু। অনুষ্ঠানের দিন তিথি হাত ধরেছিল দাদুর। স্কুলের গেটেই দাঁড়ানো ছিলেন হেড স্যার। হাতে দিল ফুলের তোড়া। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছপু মিয়ার হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এসেছেন। আমরা খুব খুশি হয়েছি। হেড স্যার বিশেষ অতিথির হাত ধরে এগিয়ে গেলেন। তিথির হাত তখন কোথায় গেল! দাদু বার কয়েক হাতড়ালেন। কিন্তু হেড স্যার আর অন্য শিক্ষকদের মাঝখানে পড়ে গেছেন। তাদের সঙ্গেই হাঁটতে হলো তাকে। একদম সামনের দিকের আসনে বসানো হলো। ফ্যান চলছিল মাথার ওপর। পাশেও চলছিল একটা। হেড স্যার ফ্যান আরও জোরে চলার আদেশ দিলেন। পানির বোতলের মুখ খুলে দিলেন নিজে। ছপু মিয়া পানি খেলেন ঢক ঢক করে। তার চোখেমুখে কেমন ভয় ভয় ভাব। দূর থেকেই তিথি বুঝতে পারছিল, দাদু এখন ওকেই খুঁজছেন। যদিও দাদুর ধারে কাছে এখন যাওয়া যাবে না। কেননা, দাদু এখন ওর দাদু নন। তিনি এখন বিশেষ অতিথি। তিথি আর স্কুলের সব শিশু মিলে জাতীয় সঙ্গীত গাইল। অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে এক সাথে চেঁঁচিয়ে বলল, স্বাগতম। লেফট রাইট লেফট রাইট হলো। সবাই মিলে স্যালুট দিল জোরসে। আর তখন তিথির বুকটা ভরে উঠল গর্বে। ও যে স্যালুটটা দিয়েছে, তা ওর দাদু বলে নয়। তিনি স্যালুট পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেই। তিথির গর্ব আরও বেড়ে গেল, যখন অনুষ্ঠান শুরু করার ঘোষণা দিলেন হেড স্যার। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছপু মিয়ার নাম বললেন। তিথির দাদু, এই কথা কিন্তু তিনি বলেননি। ছপু মিয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেই না আজকে এখানে এসেছেন। হেড স্যার বললেন, ১৯৭১ সালে ছপু মিয়া মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন করে ফিরেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা যাঁর ডাকে যুদ্ধে করেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। এই খুশির দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছপু মিয়া কিছু কথা বলবেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার বলা কথা শিশুরা শুনবে। শুনতে শুনতেই ওরা ওদের চোখ দিয়ে দেখে নেবে বঙ্গবন্ধুকে। বিশেষ অতিথি ছপু মিয়ার জন্য একদম নতুন বিষয় সব কিছু। ভালই তো বসে ছিলেন। কেন তাকে উঠতে হচ্ছে? যারা উঠিয়ে দিচ্ছেন, তারা আবার কেন তাকে টানছেন? আবার কোথাও যেতে হবে? কেন যেতে হবে? একা কেন যেতে হবে? তার তিথিমনি কোথায় গেল? তিথি অনেক দূর থেকে দেখতে চাইছিল দাদুকে। দাদু সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠছেন। পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। এক হাতে লাঠি, আরেক হাত ধরেছেন হেড স্যারের হাত। তিথি জানে, এই হাতটা ওর হাতকেই চাইছিল। ওর দাদু ওকে ছাড়া বোঝে কিছু? বোঝে না তো। দাদুকে মঞ্চে পৌঁছে যেতে দেখেনি তিথি। ওর চোখ ভরে গিয়েছিল পানিতে। দুই হাতের তালু দিয়ে চোখ মোছে। দেখে একদম মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দাদু। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছপু মিয়া। তিনি এখন বলবেন অনেক অনেক কথা। ছপু মিয়া বলছেন। কিন্তু কেউ শুনছেন না। মানে বোঝনি? বোঝার বিষয়টা কঠিন বটে। ফোঁকলা মুখের ছপু মিয়া কথা বলছেন। কিন্তু সেই কথা দাঁতহীন মুখ থেকে অনেক অনেক বাতাস নিয়ে বের হচ্ছে। ফলে সেই কথার কোন অর্থ তৈরি হচ্ছে না। কেউ বুঝতে পারছে না। ফলে কেউ শুনছে না। হেড স্যার আফসোস নিয়ে বললেন, আহা! বীর মুক্তিযোদ্ধা ছপু মিয়াকে এত দিন পরে ডাকলেন! এত দিন পরে তার কথা শুনতে চাইলেন! আরও অনেক দিন আগেই দরকার ছিল। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন এই বুড়ো মানুষটা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলতে পারবেন না। কেউ জানতে পারবে না। আফসোস! তিথি বাতাসের গতি নিয়ে পৌঁছে যায় মঞ্চে। দাদুর পাশে দাঁড়ায়। কেন দাঁড়ায়, বুঝতে পেরেছ? দাদুর কোলে কোলে বড় হয়েছে তিথি। খুব ছোট বেলাতে দাদুর কথা শুনেছে। তখনো দাদু পুরো ফোঁকলা হননি। কিন্তু তখন ও নিজে ছিল ফোঁকলা। দাঁত ছিল না। কথা বলত ফোঁকলা তিথি। সেই কথা কেউ না বুঝলেও দাদু তো বুঝতেন। তিথি বড় হতে হতে, তিথিকে যুদ্ধদিনের কথা, শেখ সাবের কথা জানাতে জানাতে ফোঁকলা হলেন। শেখ সাব কে, বুঝেছ তো? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রাম দেশের মানুষরা শেখ সাব বলেই ডাকতেন। দাদুর কথা বুঝতে তিথির কোন সমস্যা হয় না। ফোঁকলা মুখের ভাব দেখেই ও টের পায়, দাদু কি বলছেন। তিথি মাইক টেনে নেয়। বলে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ছপু মিয়া যা বলবেন, তা ও সবাইকে বলবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে বটে। তবুও কথাগুলো তো হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। যাবে, বল? তিথিও প্রশ্ন করেছিল এ রকম করেই। কথাগুলো হারিয়ে যেতে দেয়া ঠিক হবে? পুরো স্কুল এক সঙ্গে গর্জে উঠেছিল, না! সেই আওয়াজ শুনে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ছপু নড়ে ওঠেন। হাত মুঠো করে বলেন...। তিনি যা বলেন, তিথি তা-ই বলে। বলে, জয় বাংলা। তারপর দাদুর কথাগুলো তিথি সবাইকে জানিয়ে দেয়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে লড়াই করো। রেডিওতে সেই ঘোষণা শুনে ছপু মিয়া বাঁশ কাটার দাও ধার দিতে শুরু করেছিলেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বললেন, আজ থেকে দেশ স্বাধীন। ছপু মিয়া স্বাধীন দেশ থেকে ভিনদেশীদের তাড়াতে ট্রেনিং নিলেন। বঙ্গবন্ধুর খোঁজ মিলছিল না। পাকিস্তানীরা তাঁকে আটকে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে হবে। জান দিয়ে লড়েন ছপু। সহযোদ্ধা আবু, বশীর, নিতাইকে বুকে গুলি খেয়ে শহীদ হতে হয়েছিল। এতকাল পর তাদের কথা মনে পড়ে ছপু মিয়ার। কাঁদেন হাঁউমাউ করে। সেই কান্না আরও জোরালো হয় আরও বড় দুঃখে। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে হলো। তিনি ফিরলেন। সোনার বাংলা গড়তে দিন-রাত কাজ করতে লাগলেন। ছপু মিয়া আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো অস্ত্র জমা দিলেন। দেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন। কিন্তু সোনার বাংলা গড়তে পারলেন কৈ? আহারে শেখ সাব, তার মতো মানুষের বুকে গুলি চালালো পাপীরা! ছপু মিয়া শিশুর মতো কাঁদেন। কাঁদে তিথি। কাঁদেন হেড স্যার। কাঁদে সবাই। জন্মদিনে আনন্দ করার কথা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। শেখ সাবের জন্মদিন। কিন্তু কেন ওরা কাঁদছে? এই প্রশ্নের উত্তর ওরা দিতে পারছে না। তুমি কি পারবে? অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×