ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কুয়াশামাখার দিন

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

কুয়াশামাখার দিন

শীত এসেছে আগেই, শহরে শীতকাল শুরু হলো সবে। চলছে পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সারা দেশেই শীত এখন হাড়-কাঁপানো। কনকনে। ঢাকাও কাপছে শীতে। বরাবর এমন হয় না। রাজধানীতে শীত পড়ি পড়ি করেও কিসের যেন এক দ্বিধা-জড়তায় থমকে থাকে। হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই যখন দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে, দাঁতের মাঢ়ি কাঁপে ঠকঠক, ঢাকায় তখনো ঘরে ঘরে দিব্যি পাখা ঘুরতে থাকে। একেবারে দিনপঞ্জিকা ধরে শীতকাল শুরু না হলে ঢাকায় শীত আসতে বড়ই গড়িমসি করে। মহানগরে শীত আসতে দেরি হলেও শীতের দূতেরা অবশ্য পৌঁছে যেতে বিলম্ব করে না। ট্রাকে চেপে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসতে থাকে মুলা, গাজর, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শালগম, ওলকপি, শিম, পালং, পাতাসমেত পেঁয়াজ, পাটালি গুড় প্রভৃতি। এগুলোই হলো শীতের দূত। এদের শুভাগমনে নগরবাসী রসনাবৈচিত্র্যের আস্বাদে পরিতৃপ্তি লাভ করে। গা-গতরে শীত বোধ না হলেও কাঁচাবাজারের দিকে তাকালে শীত এসেছে বলে মনে হয়। শহর এক কৃত্রিমতায় পরিকীর্ণ আবাসস্থল। নিসর্গের শ্যামলিমা গ্রাস করে সে নিজেকে সম্প্রসাারিত করে চলে। শীতের সবজি রসনা তৃপ্ত করলেও দৃষ্টির তৃষ্ণা এখানে মেটে না। আমাদের দেশে শীতে তুষারপাত হয় না। শীতের ধবল রূপ এখানে নেই। কুয়াশার ধোঁয়াটে আবছা একটা ঘোর-ঘোর ভাব সকাল-সন্ধ্যায় দিগন্ত আচ্ছন্ন করে রাখে। তবে শীতের কথা বললে বাঙালীর চোখে যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, তার রং হলুদ। মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে দৃষ্টির শেষ প্রান্ত অবধি দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা সরষের খেত। মাঝেমধ্যে বসতবাড়ির সবুজ ছোপ। দূরে কুয়াশার ম্লান আঁচল নেমে আসে আকাশ থেকে। আর সামনের দিকটায় কাঁচা হলুদ ফুলগুলো ঝলমল করে সূর্যের সোনারোদের স্পর্শে। তাদের ওপরে গুনগুন করতে থাকে মৌমাছির ঝাঁক। মৃদু ঝাঁজালো সৌরভে মধুগন্ধী হয়ে ওঠে বাতাস। গায়ে চাদর জড়িয়ে গ্রামবাসী আলপথ ধরে চলতে থাকে শিশিরসিক্ত ঘাসের স্পর্শে পা ভিজিয়ে। এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য যাদের চোখে একবার পড়েছে, মনে হয় না কোনো দিন তা আর ভুলতে পারবে তারা। হাড়-কাঁপানো শীতও যে কত সুন্দর হতে পারে, তা দেখতে হলে আসতে হবে এই বাংলায়। আমার দেশের প্রান্তর এখন এই শীতে হলুদে-সবুজে, শিশিরে-সৌরভে কতই না মনোহর হয়ে আছে। শীত আমাদের দেশে বহুকাল থেকে আতিথেয়তার মৌসুম বলে সমাদৃত। ঘরে নতুন ফসল ওঠায় গ্রামের মানুষের নিত্য-অনটনের সংসারেও একটু সচ্ছলতার ছোঁয়া লাগে। ধান কাটা-মাড়াই, সবজির পরিচর্যা, বাজারজাত করা এসব নিয়ে কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে দিনগুলো। এর মধ্যে একসময় নাতিপুতি নিয়ে বেড়াতে আসে মেয়েজামাই। অতিথি আপ্যায়নে পিঠাপুলির আয়োজন থাকে বাড়িতে বাড়িতে। সম্প্রীতিতে স্নিগ্ধ সংসার। পালাগান-যাত্রাগানের আসর বসে। শীতে সারা রাত ধরে গানবাজনায় আনন্দময় থাকে গ্রামের পরিবেশ। আরও একরকমের অতিথি আছে শীতে। দূর-দূরান্ত থেকে তারা দল বেঁধে আমাদের দেশে আসে একটু উষ্ণতার জন্য। সাইবেরিয়া বা হিমালয় অঞ্চলে যখন ভয়ংকর শীত নেমে আসে, তখন সেখানকার নানা জাতের পাখপাখালি ডানায় ভর করে চলে আসে আমাদের কম শীতের দেশে। বহু বহু শতাব্দী ধরে চলছে তাদের এই শীতকালীন ভ্রমণ। নদ-নদীর চর, হাওর, জলাশয়গুলো মুখর হয়ে ওঠে তাদের কলতানে। পরিতাপের বিষয় হলো, তাদের অতিথি বললেও আতিথেয়তার প্রীতির বদলে সচরাচর আমাদের হিংস্রতার কবলেই পড়ে তারা। প্রকৃতির বিরুদ্ধতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে এসে অবলা পাখিগুলো মানুষের লোভের ফাঁদে পড়ে কিংবা বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারায়। এই লালসার ক্লেদ, এই বর্বরতার বারুদ বুক থেকে কবে যে নেমে যাবে আমাদের! জিঘাংসার ক্রূরতামুক্ত মমতাময় প্রসন্ন সুন্দর হয়ে উঠবে আমাদের শীতকাল!
×