
ছবি: সংগৃহীত
একে একে বিমান থেকে নেমে স্পেনের মাটিতে পা রাখলো ১৩ জন শিশু। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ড থেকে আনা হয়েছে তাদের। স্পেন সরকার এই শিশুদের জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সহিংসতা ও ইসরায়েলি হামলার বিপরীতে স্পেনের এমন পদক্ষেপকে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত বছরের মে মাসে স্পেন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেস মন্ত্রিসভার কাউন্সিল অফ মিনিস্টার্সের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত জানান। মিত্রদের বিরোধিতা সত্ত্বেও স্পেনের এমন অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
স্পেনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় বহুদিন ধরেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে সরকার। ১৯৯২ সালে ইসলামিক কমিশন অফ স্পেন-এর সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে স্পেন সরকার মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে। এই চুক্তির আওতায় ধর্মীয় স্থাপনার নিরাপত্তা, হালাল খাবার সরবরাহ, মসজিদের ইমামদের স্বীকৃতি এবং সরকারি স্কুলে ইসলামিক শিক্ষা চালু করা হয়।
তবে একদিকে স্পেন সরকারের এমন মানবিক ও উদার পদক্ষেপ থাকলেও অন্যদিকে স্প্যানিশ জনগণের একটি অংশের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব প্রকট হয়ে উঠছে। সম্প্রতি এ বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্পেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মুরসিয়া প্রদেশের জুমিলা শহরে।
সেখানে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার মতো মুসলিম ধর্মীয় উৎসবগুলোর জনসাধারণের স্থানে উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এটাই স্পেনে ইসলামিক উৎসবের ওপর প্রথম আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা।
জুমিলা পৌর পরিষদের অনুমোদিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নগরীর ক্রীড়া ও জনকল্যাণমূলক কেন্দ্রগুলোতে আর কোনো ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান করা যাবে না — কারণ এসব কর্মকাণ্ড “স্প্যানিশ পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।” যদিও শুরুতে প্রস্তাবটিতে সরাসরি ইসলামী উৎসব নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল, পরে একটি সংশোধনী এনে বলা হয়, শুধুমাত্র পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কার্যক্রমেই জনস্থানের ব্যবহার করা যাবে।
ডানপন্থী দল ভক্স এই প্রস্তাবে ভোট না দিলেও, তারাও এর পক্ষে সমর্থন দেয়। দলটির বিবৃতিতে বলা হয়, “স্পেন খ্রিস্টানদের ভূমি ছিল, আছে এবং থাকবে।”
এই সিদ্ধান্তে স্পেনে বসবাসরত মুসলিমদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশনস ইন স্পেন-এর সভাপতি মনির বেনজিলুইন আন্দালুসি আজহারী বলেন, “এই সিদ্ধান্ত ইসলামবিদ্বেষী এবং বৈষম্যমূলক। শুধু মুসলিমদের লক্ষ্য করেই এটা করা হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মের উৎসবের ওপর এমন নিষেধাজ্ঞা নেই। আমি গত ৩০ বছরে কখনও ভয় পাইনি, কিন্তু এখন ভয় পাচ্ছি।”
স্পেনে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে বৈষম্য?
গত ৩০ বছরে স্পেনে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। বর্তমানে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ মুসলিম, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে Pew Research Center।
এই বৃদ্ধিকে অনেক স্প্যানিশ নাগরিক মেনে নিতে পারছে না। গত বছরের জুলাইয়ে "স্পেন খ্রিস্টানদের, মুসলিমদের নয়" — এই স্লোগানে মিছিলও অনুষ্ঠিত হয়।
তবে ইতিহাস বলে, স্পেনের বিভিন্ন অংশ প্রায় ৭০০ বছর মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল। ১৪৯২ সালে খ্রিস্টান বাহিনী মুসলিমদের থেকে স্পেন পুনর্দখল করে নেয়। এরপর মুসলিমদের উপর চলে কঠোর ধর্মীয় নিপীড়ন।
প্রথমে মুসলিমদের ধর্ম পালনের অধিকার দেওয়া হলেও, পরে সেই অধিকার বাতিল করা হয়। তাদের সামনে রাখা হয় মাত্র দুটি পথ: ধর্মান্তর অথবা দেশত্যাগ।
শেখ ফরিদ