ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

“ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করো!”—জাতিসংঘে গর্জে উঠল মুসলিম বিশ্ব

প্রকাশিত: ১৮:১০, ৩১ জুলাই ২০২৫

“ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করো!”—জাতিসংঘে গর্জে উঠল মুসলিম বিশ্ব

ছবি: সংগৃহীত

জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত “ফিলিস্তিন প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ সমাধান ও দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক বাস্তবায়ন সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন”-এর শেষ দিনে বুধবার, আরব দেশগুলো একত্রে গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান সহিংসতা অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। সেইসঙ্গে তারা আবারও দৃঢ়ভাবে আরব শান্তি উদ্যোগকে মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতার একমাত্র গ্রহণযোগ্য রূপরেখা হিসেবে সমর্থন জানায়।

আরব লীগ-এর পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি, সংস্থাটির মহাসচিব আহমেদ আবুল গেইতের পক্ষে বক্তব্যে বলেন, “আজ গাজায় যা ঘটছে, এবং গোটা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার যে চিত্র আমরা দেখছি—তা এই চলমান দখলদারিত্বেরই পরিণতি।”

তিনি বলেন, “এটি এমন এক মূল্য যা ফিলিস্তিনিরা রক্ত দিয়ে দিচ্ছেন—এক ভয়াবহ মূল্য, যা আমরা সবাই পরোক্ষভাবে দিচ্ছি, যেন দখলদারিত্ব ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যায়।” তিনি যোগ করেন, “আরব শান্তি উদ্যোগের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি অটুট রয়েছে, যা ২৩ বছর আগে বৈরুতে গৃহীত হয়েছিল।”

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “এই উদার ও সুস্পষ্ট প্রস্তাবের জবাবে কোনো সদর্থক প্রতিক্রিয়া আসেনি। বরং প্রতিক্রিয়া এসেছে দম্ভ, ধর্মীয় কুসংস্কার এবং বিভাজনমূলক জাতীয়তাবাদী মনোভাব থেকে—যা গোটা অঞ্চলকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

ওমান-এর প্রতিনিধি একই সুরে বলেন, “একটি ব্যাপক ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো এবং আরব শান্তি উদ্যোগের নির্দেশনার উপর।”

তিনি অভিযোগ করেন, “ইসরায়েল একতরফাভাবে শান্তি সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও বৈধ জাতিসংঘ প্রস্তাবের প্রতি সরাসরি অমান্যতা।”

তিনি বলেন, “বর্তমান ইসরায়েলি সরকার বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে চরমপন্থী। এর নীতিমালাই শান্তি প্রক্রিয়ার যে কোনো উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করছে।”

গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে জানায়, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের সংঘাতের টেকসই সমাধান একমাত্র দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানেই সম্ভব। কাউন্সিল গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে এর অবসান দাবি করে।

তাদের প্রতিনিধি বলেন, “ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণ নীতিকে আমরা খোলাখুলি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে প্রত্যাখ্যান করছি। একইসঙ্গে, গাজায় পূর্ণমানবিক সহায়তা প্রবেশাধিকার নিশ্চিত ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের দাবি জানাচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, “সত্যিকার শ্রেষ্ঠত্ব শক্তির নয়, বরং সেই শক্তিকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহারে। এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিকভাবে সেই নীতিকে বাস্তব রূপ দেওয়ার—যার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।”

ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্রতিনিধি দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন এবং ইসরায়েলকে জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে চলার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে আগ্রাসন, গণহত্যা, ধ্বংস, উচ্ছেদ, অনাহার এবং অবরোধের মাধ্যমে গাজা উপত্যকায় অপরাধ সংঘটন করছে। পাশাপাশি, বেআইনি বসতি সম্প্রসারণ, দখল ও জাতিগত নির্মূলনীতিও চালাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমসহ পুরো এলাকায় তাদের তথাকথিত সার্বভৌমত্ব চাপিয়ে দিতে চায়—যা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ প্রস্তাবের সরাসরি লঙ্ঘন।”

এসব বক্তব্য দেওয়া হয় এমন সময়, যখন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে বলেন—গাজা সংকট এখন “চূড়ান্ত ভাঙনসীমায়” পৌঁছে গেছে। যুদ্ধবিরতির আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু ইসরায়েল তার সামরিক অভিযান বন্ধে অনড় থেকে যাচ্ছে। বরং সংবাদসূত্র বলছে, যদি হামাস যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হয়, তাহলে গাজার কিছু অংশ দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।

বুধবার ইসরায়েল সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানা গেছে, কারণ তারা গাজার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো থেকে সৈন্য সরাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

ইসরায়েলের জাতিসংঘ দূত ড্যানি ড্যানন এই সপ্তাহের জাতিসংঘ সম্মেলনকে আখ্যায়িত করেন “ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রহসন” হিসেবে।

তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, “এই সম্মেলনে বাস্তবতা থেকে বিচ্যুতি, মিথ্যা প্রচার ও সন্ত্রাসের পক্ষে সমর্থন দেখানো হয়েছে।”

এই পরিস্থিতির মধ্যেই বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভেন উইটকফ তেল আবিব সফর করবেন বলে জানা গেছে। তার এই সফর এমন সময় হতে যাচ্ছে, যখন জাতিসংঘের সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষণ সংস্থা সতর্ক করে জানিয়েছে—গাজায় “সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দৃশ্য এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।”

এই সম্মেলনের শেষ দিনে জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধি বলেন, “ইসরায়েলের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীতিগত নরম অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিসংঘের সনদের প্রতি বারবার অবজ্ঞার জন্য ইসরায়েলকে লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা ও সদস্যপদ স্থগিতের মুখোমুখি করতে হবে, যাতে জাতিসংঘের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় থাকে।”

তিনি আরও বলেন, “জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উচিত পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্র যেন বাধা সৃষ্টি করতে না পারে।”

এই সম্মেলনের একটি ফলোআপ সম্মেলন আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে।

আবির

×