ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

ইরান বা চীনের চেয়েও রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এখন উত্তর কোরিয়া

প্রকাশিত: ২০:১০, ১৬ জুলাই ২০২৫

ইরান বা চীনের চেয়েও রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এখন উত্তর কোরিয়া

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে আরও হাজার হাজার সেনা পাঠাতে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া—আরও একবার স্পষ্ট হলো যে, দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

২০২৫ সালের ১২ জুলাই উত্তর কোরিয়ার ওয়ানসানে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে হাত মেলান কিম জং উন। সেদিনের এই দৃশ্য রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্কের একটি প্রতীক হয়ে ওঠে।

বিগত মাসের শেষে পিয়ংইয়ংয়ে একটি থিয়েটারে আয়োজিত এক গালা অনুষ্ঠানে দেখানো হয়, জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনের উপর কিম জং উনের বিলাপ করার ছবি। ওই কফিনগুলোতে ছিল ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করে নিহত হওয়া ছয়জন উত্তর কোরীয় সেনার মরদেহ। অনুষ্ঠানটি ছিল কিম ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন।

যেখানে ইউক্রেনের পক্ষে ন্যাটো মিত্ররা সেনা মোতায়েন থেকে বিরত রয়েছে, সেখানে উত্তর কোরিয়ার যোদ্ধারা পশ্চিম রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে।

ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র রাশিয়া বিশ্লেষক ওলেগ ইগনাতভ বলেন,“উত্তর কোরিয়া এখন রাশিয়ার জন্য ইরান বা চীনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।”
তিনি জানান,
“উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে গোলাবারুদ এবং কিছু ভারী অস্ত্র সরবরাহ করছে। কোরীয় সেনারা শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং পেশাদার। যুদ্ধের শুরুতে তারা ড্রোন-নির্ভর আধুনিক যুদ্ধ কৌশলে দুর্বল থাকলেও দ্রুত অভিযোজিত হয়েছে।”

রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া জোট আরও গভীর হচ্ছে।

দুই সপ্তাহ আগে সিএনএনকে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়া ইউক্রেনে তাদের সেনা সংখ্যা তিনগুণ বাড়িয়ে ৩০,০০০-এ উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে।

রুশ স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মিডিয়াজোনা ও বিবিসির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ চালানোর পর থেকে রাশিয়ার প্রায় ১,১৬,০০০ সেনা হতাহত হয়েছে। অতিরিক্ত জনবলের প্রয়োজন মেটাতে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার এই সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার লাভ কী?

স্টিমসন সেন্টারের '৩৮ নর্থ' ও ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের ফেলো র‍্যাচেল মিনইয়ং লি বলেন,“উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করছে—যেটা দক্ষিণ কোরিয়া এখনও করেনি।”
তার মতে,
“রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে কিম জং উন তাৎক্ষণিকভাবে তেল, গম এবং সামরিক প্রযুক্তি পাচ্ছেন। দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত সুবিধাও মিলছে। তাই তাদের যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সংলাপে আগ্রহ কমছে।”

লি আরও বলেন,“রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিমকে চীনের উপরও চাপ প্রয়োগের বাড়তি কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সরবরাহ চেইন পুনরায় চালু করেছে রাশিয়া।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ডিজোরিয়া বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য নেইমাত খালিলভ জানান,রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার মধ্যে খাসান-টুমেন সীমান্তপথে পুনরায় বাণিজ্যিক ট্রাফিক চালু হয়েছে।”
রাশিয়া এখন উত্তর কোরিয়াকে কয়লা, সার ও লৌহ আকরিক সরবরাহ করছে; আর উত্তর কোরিয়া দিচ্ছে সামুদ্রিক খাবার ও বিরল খনিজ।

তিনি আরও বলেন,“রাশিয়া এখন উত্তর কোরিয়ার রাজিন বন্দরের আধুনিকীকরণে বিনিয়োগ করছে, যাতে এটি দক্ষিণ কোরিয়ার বিকল্প বাণিজ্যিক হাব হয়ে উঠতে পারে।”

‘সম্পর্কের নতুন ধাপ’

উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায়, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপানিদের পরাজিত করেছিল। দক্ষিণে একই কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত সমর্থনে কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার উত্থান ঘটেছিল, যা ছিল দীর্ঘকালীন মিত্র। তবে ৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর উত্তর কোরিয়া বড় ধরনের খাদ্য সংকটে পড়ে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হয়।

২০০০ ও ২০১০ দশকে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে পারমাণবিক কার্যক্রম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় সায় দিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ (SMO) শুরুর পর এই সম্পর্ক এক নতুন স্তরে পৌঁছায়।

২০২২ সালের শুরুতেই উত্তর কোরিয়া জাতিসংঘে মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণ নিন্দার প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়া পাঁচটি দেশের একটি ছিল—বাকি চারটি দেশ হলো: বেলারুশ, ইরিত্রিয়া, সিরিয়া ও রাশিয়া নিজেই।

২০২৩ সালে তৎকালীন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু উত্তর কোরিয়া সফর করেন। এরপর কিম জং উন রাশিয়া সফরে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। যৌথ বিবৃতিতে “مشترك মূল্যবোধ” ও “কৌশলগত অংশীদারিত্ব”-এর ওপর জোর দেওয়া হয়।

খালিলভ জানান, গত জুনে স্বাক্ষরিত 'কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ' চুক্তির ৪নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একে অপরের বিরুদ্ধে বিদেশি আগ্রাসন হলে সামরিক ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া যাবে। এই চুক্তির আওতাতেই কুর্স্ক যুদ্ধে ১৫,০০০ কোরীয় সেনা মোতায়েন করা হয়।

প্রথমে এই সেনা উপস্থিতি অস্বীকার করেছিল রাশিয়া।
২০২৪ সালের শেষ দিকে ইউক্রেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুর্স্কে আহত উত্তর কোরীয় সেনারা রাশিয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিল। তারা ‘রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের সংখ্যালঘু’ পরিচয়ে ভুয়া পরিচয়পত্র পেয়েছিল যাতে নিহত হলেও শনাক্ত করা না যায়।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করেন,“যুদ্ধক্ষেত্রে আটক হওয়ার উপক্রম হলে উত্তর কোরীয় সেনাদের নিজেদের পক্ষ থেকেই মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি থাকে।”

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এই যৌথ সেনা অংশগ্রহণ স্বীকার করে।
পুতিন উত্তর কোরীয়দের "ন্যায়বিচার ও ভ্রাতৃত্ববোধ" দেখানোর জন্য ধন্যবাদ জানান।
কিম বলেন, এটি তাদের সেনাদের “পবিত্র দায়িত্ব”।

রুশ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, নিহত উত্তর কোরীয় সেনাদের স্মরণে কুর্স্কে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও সড়কপথের নামকরণ করা হবে।

রাশিয়ার নির্বাসিত পত্রিকা ‘নোভায়া গেজেটা’-তে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিয়োডর ক্রাশেনিননিকভ জানান,“প্রথমদিকে বিষয়টি গোপন রাখা হয় সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার অনুরোধেই—তারা নিজস্ব প্রচারণা ও আদর্শ অনুযায়ী এই বিষয়টি জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল।”

Jahan

×