
ছবি: সংগৃহীত।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস প্রতি বছর ২৮ জুলাই পালিত হয়। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ভাইরাল হেপাটাইটিস বিশ্বব্যাপী একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রোগ নিয়ে সচেতনতা ও সঠিক জ্ঞান এখনও অত্যন্ত কম। এর ফলে সমাজে বিভিন্ন ভুল ধারণা ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়েছে, যা প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা গ্রহণ ও প্রতিরোধে বাধা সৃষ্টি করছে।
ভ্রান্ত ধারণা ১: হেপাটাইটিস সবসময় অ্যালকোহল বা দূষিত খাবারের কারণে হয়।
অনেকেই মনে করেন, বেশি মদ্যপান বা নোংরা খাবার খেলে হেপাটাইটিস হয়। বাস্তবে ভাইরাল হেপাটাইটিস মূলত কয়েকটি ভাইরাসের (হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ও ই) কারণে হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস A ও E দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে ছড়ালেও, হেপাটাইটিস B, C ও D রক্ত ও শরীরের তরলের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। শুধুমাত্র জীবনযাপনের ওপর দোষ চাপালে প্রকৃত সংক্রমণের পথগুলো উপেক্ষিত থেকে যায়।
ভ্রান্ত ধারণা ২: হেপাটাইটিস বি ও সি মানেই মৃত্যু।
বর্তমানে সময়মতো শনাক্ত হলে হেপাটাইটিস বি ও সি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের মাধ্যমে ভাইরাস দমন, লিভারের প্রদাহ কমানো এবং লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারে রূপ নেওয়া ঠেকানো সম্ভব হয়। সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে রোগীরা দীর্ঘ, স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।
ভ্রান্ত ধারণা ৩: শুধু অসুস্থ বা দুর্বল দেখালেই হেপাটাইটিস ছড়ায়।
বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি ও সি অনেক বছর পর্যন্ত কোনো উপসর্গ ছাড়াই শরীরে বাস করতে পারে। এই নীরবতা অনেক সময় রোগ শনাক্তকরণে বিলম্ব ঘটায়। ফলে সুস্থ মনে হলেও কেউ হয়তো অন্যদের সংক্রমিত করছেন। তাই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মাঝে নিয়মিত স্ক্রিনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভ্রান্ত ধারণা ৪: স্বাস্থ্যবান হলে ভ্যাকসিনের দরকার নেই।
হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে ভ্যাকসিন সবচেয়ে কার্যকর উপায়। জন্মের পর শিশুদের, যেসব প্রাপ্তবয়স্ক এখনও টিকা নেয়নি এবং যাঁরা ঝুঁকির মধ্যে আছেন, তাঁদের ভ্যাকসিন নেয়া জরুরি। হেপাটাইটিস A-ও প্রতিরোধযোগ্য। তাই সুস্থ থাকা মানেই টিকার প্রয়োজন নেই-এটা ভুল ধারণা।
ভ্রান্ত ধারণা ৫: ট্যাটু ও পিয়ার্সিং সম্পূর্ণ নিরাপদ।
অপরিচ্ছন্ন বা অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ট্যাটু বা দেহে ছিদ্র (পিয়ার্সিং) করালে হেপাটাইটিস বি ও সি সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। ব্যবহৃত সূঁচ বারবার ব্যবহার বা জীবাণুমুক্ত না হলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই এসব কাজ প্রশিক্ষিত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্থানে করানো উচিত।
ভ্রান্ত ধারণা ৬: কর্মস্থলে হেপাটাইটিস কোনো বিষয় না।
কর্মক্ষেত্রেও হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা ও পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় কর্মীরা লজ্জা, ভয় বা স্বাস্থ্যসেবার অভাবে রোগ গোপন রাখেন। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ রোগীদের সাহায্য করে।
ভ্রান্ত ধারণা ৭: একবার ধরা পড়লে কিছুই করার থাকে না।
আসলে সঠিক চিকিৎসা, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে হেপাটাইটিস অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অ্যালকোহল বর্জন, স্বাস্থ্যকর খাবার, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ নিয়মিত গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটাই কমে।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগ নিয়ে সমাজে যেসব ভুল ধারণা রয়েছে, সেগুলো রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় বাধা। হেপাটাইটিস একটি প্রতিরোধযোগ্য, নিয়ন্ত্রণযোগ্য, এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য রোগ।
সঠিক তথ্য প্রচার, টিকা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা উৎসাহিত করা এবং খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে আমরা মানুষকে নিজেদের স্বাস্থ্যরক্ষায় সচেতন করতে পারি। পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হেপাটাইটিস মোকাবেলা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এসওএস-এর মেডিকেল ডিরেক্টর ও চিফ হেলথ অফিসার (ইন্ডিয়ান সাবকনটিনেন্ট) ডা. বিক্রম ভোরা বলেন,
“সচেতনতা শুধু মনোভাবই পাল্টায় না, জীবনও বাঁচায়। আসুন, মিথ ভেঙে সত্য তুলে ধরি।”
সূত্র: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।
মিরাজ খান