
ছবি: সংগৃহীত।
পুরুষ ও নারী—শরীরের প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন হতে পারে, বিশেষ করে স্ট্রোকের লক্ষণগুলোতে। স্ট্রোক সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ যেমন—হঠাৎ অসাড় হয়ে যাওয়া, কথা বলতে অসুবিধা, তীব্র মাথাব্যথা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো আরও সূক্ষ্ম, অপ্রত্যাশিত এবং বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
এই লক্ষণগুলোর অনেকগুলোই মানসিক চাপ, ক্লান্তি বা হজমের সমস্যার মতো মনে হতে পারে, ফলে সময়মতো চিকিৎসা নিতে দেরি হয়ে যায়—যা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে স্ট্রোকের কিছু গোপন ও অবহেলিত উপসর্গ জেনে রাখা জীবন বাঁচাতে সহায়ক হতে পারে।
১. আচরণগত পরিবর্তন বা হঠাৎ বিভ্রান্তি:
নারীরা স্ট্রোকের সময় হঠাৎ করে অস্বাভাবিক আবেগপ্রবণতা, বিভ্রান্তি বা আচরণগত পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে পারেন। প্রিয়জনকে চিনতে না পারা, ঘন ঘন বিভ্রম হওয়া বা হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠার মতো আচরণ দেখা যেতে পারে। অনেক সময় এগুলো মানসিক চাপ, প্যানিক অ্যাটাক বা ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ বলে ভুল হয়, ফলে চিকিৎসা পেতে দেরি হয়।
২. চরম ক্লান্তি:
স্ট্রোকের আগে বা চলাকালে নারীরা অনেক বেশি দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। এটি সাধারণ ক্লান্তি নয়—এমন একধরনের অবসাদ যা কোনো কাজই করতে দেয় না। এই ক্লান্তিকে অনেকেই কর্মব্যস্ততা বা পারিবারিক চাপ বলে ভুল করেন, ফলে সমস্যা চিহ্নিত করতে দেরি হয়।
৩. হঠাৎ হেঁচকি শুরু হওয়া:
নারীদের মধ্যে স্ট্রোকের এক বিস্ময়কর লক্ষণ হতে পারে বারবার হেঁচকি ওঠা। মস্তিষ্কের ব্রেইনস্টেমে স্ট্রোক হলে এই হেঁচকি হতে পারে। এটি অনেক সময় বুক ধড়ফড়, গলা অস্বস্তি বা বমির ভাবের সঙ্গে দেখা দেয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণ খুব কমই দেখা যায়, ফলে নারীদের ক্ষেত্রে এটি প্রায়ই অবহেলিত হয়।
৪. হঠাৎ বমি বা বমিভাব:
স্ট্রোকের সময় হঠাৎ বমি, মাথা ঘোরা বা বমিভাব দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের পেছনের অংশ আক্রান্ত হলে। এই লক্ষণ অনেক সময় খাবার খারাপ হওয়া, ভাইরাসজনিত সংক্রমণ বা মানসিক অস্থিরতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই লক্ষণ বেশি দেখা যায়।
৫. বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট:
অনেকে মনে করেন, বুকে ব্যথা মানেই হার্ট অ্যাটাক। তবে এটি স্ট্রোকের লক্ষণও হতে পারে, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। অনেক নারী জানান, তারা বুকে টান, চাপ বা অস্বস্তি অনুভব করেন, সঙ্গে থাকে শ্বাসকষ্ট। এটি ভুলভাবে হৃদরোগ বা উদ্বেগজনিত সমস্যা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ফলে চিকিৎসা নিতে দেরি হয়।
৬. তীব্র ও অজানা মাথাব্যথা:
হঠাৎ করে শুরু হওয়া প্রবল মাথাব্যথা স্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। নারীরা যেহেতু মাইগ্রেন সমস্যায় বেশি ভোগেন, অনেক সময় এই মাথাব্যথাকে সাধারণ মাইগ্রেন মনে করা হয়। তবে স্ট্রোকের মাথাব্যথা খুব তীব্র হয়, হঠাৎ শুরু হয় এবং ঘুম বা ওষুধেও উপশম হয় না।
৭. সামগ্রিক দুর্বলতা (শুধু এক পাশে নয়):
স্ট্রোকের ক্লাসিক লক্ষণ হলো শরীরের এক পাশ দুর্বল হয়ে যাওয়া। কিন্তু নারীরা অনেক সময় পুরো শরীরেই দুর্বলতা বা ভারী অনুভব করতে পারেন। এটি স্ট্রোক চিহ্নিত করাকে জটিল করে তোলে। শরীর ঠিকমতো কাজ করছে না মনে হলে তা অবহেলা করা ঠিক নয়।
স্ট্রোক প্রতিরোধে আপনি যা করতে পারেন-
ভালো খবর হলো—সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করলে অনেক স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য। বিশেষজ্ঞরা নিচের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন:
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
নিয়মিত শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন।
সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন: প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলুন; ফলমূল, শাকসবজি বেশি খান।
হরমোন সম্পর্কিত পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতন থাকুন: জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ, গর্ভাবস্থা বা মেনোপজ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
ধূমপান ছাড়ুন: ধূমপান স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। এখনই ছাড়লে উপকার মিলবে দ্রুত।
শরীরের সংকেত শুনুন: কোনো অস্বাভাবিকতা টের পেলে অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসা নিন।
স্ট্রোক সবসময় টিভিতে দেখা প্রচলিত উপসর্গ দিয়ে শুরু হয় না, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। এই উপেক্ষিত লক্ষণগুলো জানা থাকলে হয়তো আপনি কারো জীবন বাঁচাতে পারবেন—হতে পারে সেটা আপনার নিজের। কারণ স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্রতিটি সেকেন্ডই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, ‘সতর্ক থাকাই শ্রেয়’।
মিরাজ খান