
ছবি : প্রতীকী
অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা (Obstetric Fistula) হল এক ধরনের চিকিৎসাগত জটিলতা, যা সাধারণত দীর্ঘ সময় প্রসব যন্ত্রণার (prolonged or obstructed labor) ফলে ঘটে। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে প্রসবের সময় গর্ভধারণকারী নারীর যোনি (vagina) ও মূত্রথলি (urinary bladder) অথবা মলদ্বার (rectum)-এর মধ্যে একটি অস্বাভাবিক পথ বা ছিদ্র তৈরি হয়। এর ফলে প্রসবের পর নারী নিজের মূত্র বা মল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, অবিরাম মূত্র বা মল নির্গমন হতে থাকে। যা কেবল শারীরিক নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিকভাবেও তাদের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়।
প্রতি বছর ২৩ মে তারিখে আন্তর্জাতিক অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা দিবস (International Day to End Obstetric Fistula) পালন করা হয়। এই দিনটি জাতিসংঘের উদ্যোগে নির্ধারিত হয়েছে, যাতে অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো যায় এবং এই সমস্যার শিকার নারীদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যায়। জাতিসংঘ ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো ২৩ মে-কে আন্তর্জাতিক অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এটি জাতিসংঘের UNFPA (United Nations Population Fund) কর্তৃক পরিচালিত “Campaign to End Fistula” উদ্যোগের অংশ।
এর প্রধান কারণ:
- দীর্ঘ সময় প্রসবের সময় শিশুর মাথা যখন পেলভিসে চেপে থাকে এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তখন আশেপাশের টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়।
- সিজার বা জরুরি অস্ত্রোপচারের সুযোগ না থাকা।
- অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদান।
উপসর্গ (Symptoms):
- প্রসবের পর অবিরাম মূত্রপাত বা মল নির্গমন
- যোনিপথ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব
- যৌন জীবনে সমস্যা
- ত্বকে জ্বালা ও সংক্রমণ
চিকিৎসা:
- এটি একটি সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ছিদ্র বন্ধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।সার্জারি না হলে রোগিণী আজীবন এই সমস্যায় ভুগতে পারেন।
প্রতিরোধ:
- প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করা
- কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ এড়ানো
- সঠিক সময় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া
ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারীরা প্রায়শই পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, যা তাদের গভীর হতাশা ও নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দেয়। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল এই সমস্যা দূরীকরণে বিশ্বব্যাপী অ্যান্ড ফিস্টুলা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে।
সংস্থাটি ফিস্টুলাকে একটি সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য ও নিরাময়যোগ্য অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রয়োজনীয় প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে দক্ষ ধাত্রী বা স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি এবং জরুরি সিজারিয়ান সেবার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ফিস্টুলা প্রতিরোধ করা সম্ভব। একবার ফিস্টুলা হয়ে গেলে, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এটি সফলভাবে নিরাময় করা যায়।
দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সবার প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে, যেন এই নীরব মহামারীতে আক্রান্ত নারীদের পাশে দাঁড়ানো হয় এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন বাড়ানো হয়, যাতে তারা সুস্থ জীবন ফিরে পেতে পারেন এবং সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারেন।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রসবজনিত কারণে মারা যান ১৪ জন নারী। আর এই ১৪ জন নারীর মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ নারীর মৃত্যু হয় বাধাগ্রস্ত বা বিলম্বিত প্রসবের কারণে। তবে বাংলাদেশে ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা কত- এ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা সার্জন্সের (আইএসওএফএস) তথ্য মতে, ২০২৪ সালে দেশে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর অনুমিত সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৫৭ জন। এর মধ্যে অস্ত্রোপচার হয়েছে ৩ হাজার ১০৯ জনের। অর্থাৎ ৮২ শতাংশ নারী চিকিৎসার আওতার বাইরে আছেন।
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। প্রতি এক হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে ১ দশমিক ৬৯ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত।
জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাতীয় ফিস্টুলা সেন্টারসহ দেশের ১১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর মধ্যে ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ প্রসূতি ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সে প্রথম প্রসব করেছিলেন। ফিস্টুলা রোগীদের মধ্যে ৩০ দশমিক ৪ শতাংশের বয়স ছিল ৪০ থেকে ৪৯ বছর, ৫০ বছরের বেশি ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ, ২৬ দশমিক ১ শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৯ বছর, ৮ দশমিক ৭ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৯ বছর। এসব রোগীর ৭৯ দশমিক ৩ শতাংশের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দেশের ১৮টি হাসপাতালে ভর্তি ৭১৯ জন ফিস্টুলা রোগীর ওপর চালানো এই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে গড়ে ১৮ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর এসব রোগীর ৭০ শতাংশ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
এ ছাড়াও জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রসবজনিত (বাধাগ্রস্ত প্রসব) কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্তদের হার ৫৭ শতাংশ। আর জরায়ু অপসারণ করতে যে অস্ত্রোপচার হয়, সে ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ এবং অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের পরবর্তী আঘাতের কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন ৪০ শতাংশ নারী।
সা/ই