
মানবদেহের জন্য ঘুম কেবল বিশ্রামের একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি শরীর ও মস্তিষ্কের সার্বিক সুস্থতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। কিন্তু আজকের ব্যস্ত ও স্ট্রেসপূর্ণ জীবনে নিয়মিত ঘুম হারিয়ে যাচ্ছে বহু মানুষের জীবন থেকে। ফলাফল শরীরের প্রতিটি অঙ্গে তার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে অন্তত ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুমের ঘাটতি প্রতিনিয়ত শরীর ও মনের ওপর এমন সব প্রভাব ফেলে, যা ধীরে ধীরে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রূপ নিতে পারে।
মস্তিষ্ক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব
ঘুম কম হলে প্রথমেই যেটি আক্রান্ত হয়, তা হলো আমাদের মস্তিষ্ক। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্পষ্টতা দেখা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটানা দু’দিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যেন কেউ ০.১ শতাংশ অ্যালকোহলে মাতাল। এর পাশাপাশি, উদ্বেগ (anxiety) এবং বিষণ্নতা (depression)-র ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের ঘাটতি মানসিক রোগে রূপ নিতে পারে, এমনকি আলঝেইমার বা স্মৃতিভ্রষ্টতার মতো জটিল অবস্থাও দেখা দিতে পারে।
হৃদ্রোগ ও রক্তচাপ বেড়ে যায়
নিয়মিত ঘুম কম হলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়। ঘুমের সময় শরীরের স্নায়ুতন্ত্র স্বাভাবিক ছন্দে থাকে এবং হৃদপিণ্ড বিশ্রাম পায়। কিন্তু ঘুম না হলে স্নায়ু উত্তেজিত অবস্থায় থাকে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। আমেরিকার Mayo Clinic এবং Cleveland Clinic-এর গবেষণা অনুযায়ী, মাত্র ৩ রাত পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরে প্রদাহজনিত উপাদান বৃদ্ধি পায়, যা সরাসরি হৃদ্রোগের কারণ হতে পারে।
ডায়াবেটিস ও বিপাকীয় সমস্যা
ঘুমের অভাবে শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা হ্রাস পায়। এর ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের দিকে ঠেলে দেয়। যাঁরা রাতে কম ঘুমান, তাঁদের ওজন দ্রুত বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়, কারণ ঘুমের ঘাটতিতে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ‘ঘ্রেলিন’ বেড়ে যায় এবং ‘লেপ্টিন’ কমে যায়—ফলে অনিয়ন্ত্রিত খাওয়ার প্রবণতা জন্ম নেয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে
ঘুম শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা অন্যান্য সংক্রমণের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। Mayo Clinic-এর তথ্য অনুযায়ী, ঘুমের ঘাটতির ফলে সাধারণ ঠান্ডা-জ্বর এমনকি ফ্লু-তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।
ত্বক ও বাহ্যিক সৌন্দর্যে প্রভাব
ঘুমের ঘাটতির আরেকটি দৃশ্যমান প্রভাব পড়ে আমাদের ত্বকে। চোখের নিচে কালি পড়ে, ত্বকে ক্লান্তির ছাপ দেখা দেয়, এবং বয়ঃজনিত চিহ্ন (aging signs) দ্রুত স্পষ্ট হয়। নিয়মিত ঘুম না হলে কোলাজেনের উৎপাদন ব্যাহত হয়, ফলে ত্বক হারিয়ে ফেলে তার প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা।
যৌন স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
গবেষণা বলছে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে যায় এবং মহিলাদের যৌন আকাঙ্ক্ষাও কমে যেতে পারে। এর ফলে দাম্পত্য জীবনেও প্রভাব পড়ে। ঘুম ভালো হলে হরমোন ব্যালান্স থাকে স্বাভাবিক এবং দেহে যৌন উদ্দীপনাও বজায় থাকে।
স্মৃতি ও শেখার ক্ষমতা কমে যায়
ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কে ‘মেমোরি কনসলিডেশন’ ঘটে।অর্থাৎ দিনভর শেখা ও অভিজ্ঞতাগুলো মস্তিষ্ক সংগঠিত করে রাখে। ঘুম কম হলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে পড়াশোনা, কাজ কিংবা নতুন কোনো দক্ষতা শেখার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে।
ঘুম ভালো রাখতে যা করবেন
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
ঘুমের আগে মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ ব্যবহার কমিয়ে দিন
রাতে চা-কফি এড়িয়ে চলুন
অন্ধকার ও ঠান্ডা পরিবেশে ঘুমানোর চেষ্টা করুন
ব্যায়াম করুন, তবে ঘুমের আগ মুহূর্তে নয়
ঘুম যেন আর বিলাসিতা না হয়ে ওঠে। এটি আপনার জীবনের অপরিহার্য একটি অংশ। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে, নিরবিচারে ঘুমানোই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি।
সূত্র:https://tinyurl.com/2f5uh8vz
আফরোজা