.
ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইনসুলিন যেন প্রাণভোমরা। ইনসুলিন আবিষ্কারের পূর্বে টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীরা নীরবে মৃত্যুর প্রহর গুনত। ডায়াবেটিস নির্ণিত হলে তাদের জীবনে মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠত। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের পাশাপাশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস চিকিৎসার একপর্যায়ে ইনসুলিন ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। যারা চিকিৎসার জন্য ইনসুলিন ব্যবহার করছেন তাদের জন্য অনেকগুলো বিষয় জেনে রাখা খুবই জরুরি।
ইনসুলিন সংরক্ষণ : এটি অত্যাধিক উষ্ণ কিংবা নিম্ন তাপমাত্রায় নষ্ট হয়ে যায়। সরাসরি রোদের সংস্পর্শে কিংবা ডিপ ফ্রিজে রাখলে এটির কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। সেজন্য ইনসুলিন সংরক্ষণের উপযোগী ব্যবস্থাপনা আছে কিনা এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইনসুলিন সংরক্ষণ করতে হবে সাধারণ ফ্রিজে, ডিপ ফ্রিজে নয়। ইনসুলিন সংরক্ষণের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা হলো দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদি ঘরে ফ্রিজ না থাকে তবে ইনসুলিন ভায়ালের বদলে কলম ব্যবহার করা যেতে পারে। কেননা ইনসুলিনের কলম ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যেতে পারে। দুর্যোগ দুর্বিপাক তো বলে কয়ে আসে না। সেজন্য ঘরে এক থেকে তিন মাসের জন্য ইনসুলিন সংরক্ষণ করে রাখা যেতে পারে।
দেখে নিন ইনসুলিনের মেয়াদ, চেহারা : ইনজেকশন নেওয়ার আগে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ পরীক্ষা করা দরকার। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে বিপদ নেমে আসতে পারে।
ভালো করে দেখে নিন ইনসুলিনের চেহারা ঠিক আছে কিনা। ঘোলাটে হয়ে গেলে, রং বদলে গেলে কিংবা অধক্ষেপ পড়ে থাকলে ব্যবহার করা যাবে না। এমনটি হলে দোকানে ফেরত দিন। নতুন কোনো ভায়াল কিংবা কলম ব্যবহারের জন্য খুললে তারিখ লিখে রাখতে হবে। এটি আপনাকে সাহায্য করবে কখন তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে তা বলার জন্য। চার সপ্তাহ পর খোলা ভায়াল আর ব্যবহার করবেন না।
সিরিঞ্জ এবং সুঁইয়ের যত্ন : সিরিঞ্জ ব্যবহারে সতর্ক হোন। এক সিরিঞ্জ বারবার ব্যবহার করা কখনো ঠিক না। চিকিৎসা করতে গেলে পকেটের দিকেও দৃষ্টি মেলতে হয়। যাদের হাতে ক্ষত কিংবা প্রদাহ রয়েছে তারা বারবার একই সিরিঞ্জ ব্যবহারের ঝুঁকি নেবেন না। ইনজেকশন নেওয়ার পর সুঁই ক্যাপের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে হবে। ফ্রিজে কখনো সুঁই খোলা রাখা অবস্থায় ঠিক হবে না এতে এর ভেতর দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে আটকে যেতে পারে যা ইনসুলিনের মাত্রায় গোলযোগ পাকাতে পারে।
এটি যাতে অন্যকিছুর সংস্পর্শে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একজনের সিরিঞ্জ অন্যজনে ব্যবহার করা যাবে না। যখন সুঁই ভোঁতা হয়ে যায় কিংবা বেঁকে যায় অথবা অন্য কোনো কিছুর সংস্পর্শে আসে তখন তা ফেলে দিন। সুঁই ফেলে দেওয়ার সময় খুলে ফেলুন। কখনো কেচি দিয়ে এটি কাটতে যাবেন না। এতে উড়ন্ত সুঁই এসে চোখমুখে লেগে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। ইনসুলিনের কলম ব্যবহারের পর ফ্রিজে রাখার দরকার নেই।
ইনসুলিন প্রয়োগের স্থান : ইনসুলিনের প্রয়োগের স্থানটি ভালোভাবে পরখ করা দরকার। বারবার ইনসুলিন প্রয়োগের ফলে ত্বকের পুরুত্ব বেড়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে লিপো-হাইপারট্রফি। কখনো চামড়ার পুরুত্ব কমেও যেতে পারে। চামড়ার পুরুত্বের এই তারতম্য আছে কিনা ইনসুলিন প্রয়োগের পূর্বে তা পরখ করে নিতে হবে। প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার ইনসুলিন প্রয়োগ করার স্থান চিকিৎসকের নজরে আনা দরকার। যদি ইনজেকশনের স্থানে এমনটি ঘটে কিংবা ফুলে যায় অথবা কোনো ক্ষত প্রদাহ কিংবা ফোসকা পড়ে তবে সেখানে ইনজেকশন দেওয়া যাবে না।
ইনসুলিন প্রয়োগের উৎকৃষ্ট স্থান পেটের চামড়ার নিচে। একজন মানুষের চামড়া দুই থেকে চার মিলিমিটার পুরু। এর নিচেই রয়েছে চর্বির স্তর। নাভি থেকে দেড় দুই ইঞ্চি দূরে উপরে ও নিচে ভূমির সমান্তরালের অনেক খানি জায়গা ইনসুলিন প্রয়োগের আদর্শ স্থান। এছাড়া ঊর্ধ্ব-বাহু এবং ঊরুর দেহের বাইরের দিকের মাঝের এক তৃতীয়াংশে এটি প্রয়োগ করা যায়। ছোট বাচ্চাদের নিতম্ব দেশে ইনসুলিন দেওয়া যেতে পারে।
ইনজেকশন দেওয়ার আগে স্থানটি পরিষ্কার কিনা দেখে নিতে হবে। অপরিচ্ছন্ন চামড়ায় ইনসুলিন দিলে ইনফেকশন হতে পারে। পরিষ্কার হাতে চামড়া পরিষ্কার-পূর্বক ইনসুলিন প্রয়োগ করতে হবে। তুলোর বল নিরাপদ পানিতে কিংবা অ্যালকোহলে ভিজিয়ে স্থানটি পরিষ্কার করতে হবে। পরিষ্কার করার সময় কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে পরিষ্কার করে দিতে হয়। অ্যালকোহল শুকিয়ে যাওয়ার পর তবে ইনজেকশন দিতে হবে। একই জায়গায় বারবার না দিয়ে জায়গা বদল করে ইনজেকশন দিতে হবে।
লেখক : মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট,
সিএমএইচ, ঢাকা।
চেম্বার : আল রাজী হাসপাতাল (২য় তলা) ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৫৬১৭৩৭৬৫, ০১৭২৬০৫০৯১২