
ফাইল ছবি।
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা একের পর এক রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৯৫৯ জন। যা চলতি বছর একদিনে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে সর্বোচ্চ। এর আগে গত বুধবার একদিনে ২ হাজার ৮৪৪ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। দৈনিক আক্রান্তের দিক দিয়ে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ। এরও আগে গত রবিবার একদিনে রেকর্ড ২ হাজার ৭৬৪ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে হিসাবে পাঁচদিনের ব্যবধানে তিনবার চলতি বছরের দৈনিক আক্রান্তের রেকর্ড ভাঙল।
আগস্ট মাসের প্রথম ৮ দিনেই দেশে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের হার ছাড়িয়েছে ২০ হাজারের ওপর। যা গত জুলাই মাসের পুরোটায় ছিল ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন। এমন অবস্থায় খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করছে, আগস্টে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে রোগীর চাপ। কিন্তু রাজধানীর শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দুই/একটি হাসপাতালেই রোগী ভর্তি হতে যাচ্ছেন। বিশেষ করে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সিট না পেয়ে মেঝে এমনকি বারান্দায় থেকেও চিকিৎসা নিচ্ছে অনেকে। এসব হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারলে অনেকে পার্শ্ববর্তী বেসরকারি হাসপাতালে উচ্চমূল্যেও চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বিপরীতে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল অর্থাৎ ডিএনসিসির করোনা হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ একেবারেই কম। এর কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুগদা, জুরাইন, যাত্রাবাড়ীসহ পুরান ঢাকার এলাকাগুলোতেই ডেঙ্গু রোগী বেশি হওয়ায় আশপাশের হাসপাতালেই সেবা নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন রোগী এবং তাদের স্বজনরা। আর তাই এলাকাভিত্তিক হাসপাতালগুলোতেই বাড়ছে রোগীর চাপ। তবে মধ্য আগস্টে রোগী বাড়লে অন্যান্য হাসপাতালও প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭ জন এবং ঢাকার বাইরের ৫ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬৪ জনে। অধিদপ্তর জানায়, বুধবার (৯ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৯৫৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ৯৭ জন ও ঢাকার বাইরের ১ হাজার ৮৬২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আশা করেছিলাম আগস্টের শেষে ডেঙ্গু রোগী কমে স্বস্তিকর জায়গায় যেতে পারে। এর কারণ। অতীত বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে কোনো রোগের প্রাদুর্ভাবে একটা সময় সর্বোচ্চ পরিমাণ হয়ে এর পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তবে সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর একইভাবে মিল থাকবে তাও না। গত বছর অক্টোবরে এসে ডেঙ্গু কমতে শুরু করে। তবে এবার সেটা আগস্টেও হতে পারে। আগস্ট মাস ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে পারলে আশা করা যায় এ রোগটায় আক্রান্ত কিছুটা কমে আসবে এবং একটা স্বস্তিকর জায়গায় যাওয়া যাবে। কিন্তু সপ্তাহের ব্যবধানে বিপরীত পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। আগস্টের প্রথম এক সপ্তাহেই রোগীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়, সম্প্রতি ঢাকার বাইরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গু আক্রান্তের যে পরিস্থিতি তাতে এ হারে যদি সংক্রমণ বাড়ে এবং যদি স্থিতিশীলতা না আসে তাহলে আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার অন্যান্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, দেশে জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার অনেক বেশি ছিল। এমনকি আগস্ট মাসে এসেও ঊর্ধ্বমুখী। যা দেশে ডেঙ্গুর অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীর হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে ৬০০ শয্যার মধ্যে রোগী রোগী ভর্তি ছিল ৪২৪ জন। এর পরই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৩৭৭ জন। মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ২৭৩ জন। আর ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে ২৯২ জন।
তবে সরেজমিনে দেখা যায়, মুগদা হাসপাতালে সিট না পেয়ে রোগীরা পার্শ্ববর্তী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন। খিলগাঁও গোড়ান বাজারের বাসিন্দা শাহজাহানের স্ত্রী ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে নিয়ে যান মুগদা হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে সিট না থাকায় ভর্তি করাতে পারেননি। পরে তাকে ভর্তি করান পার্শ্ববর্তী বেসরকারি বারাকাহ্ হাসপাতালে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তো বলছে যে, মুগদায় সিট ফাঁকা রয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রীকে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা সিট ফাঁকা নেই। মেঝেতে থাকতে হবে বলে জানিয়ে দেয়। তাই পরে বাধ্য হয়ে এখানে ভর্তি করিয়েছে। খরচ বেশি হচ্ছে কিন্তু কি আর করা, জীবন তো বাঁচাতে হবে।
একই অভিযোগ করেন গোড়ান মক্কা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা নাসিমা ভুঁইয়া। ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে পর পর তিনদিন মুগদা হাসপাতালে নিয়ে গেলেও ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়ে পরে ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ভর্তি করালেও পর্যাপ্ত চিকিৎসক এবং নার্স নেই বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, অনেক সময় এ হাসপাতালটিকে ভূতুড়ে হাসপাতাল বলে মনে হচ্ছে। এতবড় হাসপাতাল অথচ চিকিৎসক-নার্স এমনকি রোগীও বেশি নেই। চিকিৎসা করাব কি আতঙ্কেই মরে যাচ্ছি।
সরেজমিনে হাসপাতালটি পরিদর্শনেও মেলে সত্যতা। হাসপাতালটিতে আসা বেশিরভাগ রোগী মহাখালী, মিরপুর, বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা। প্রতিদিন হাসপাতালটিতে গড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ জন নতুন রোগী এলেও গড়ে ভর্তি করা হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ জন। একই সঙ্গে সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরছেন ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো রোগী
হাসপাতালটির পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে জানা যায়, গত বুধবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত জ্বর-সর্দি এবং ডেঙ্গু নিয়ে ১৭০ রোগী এখানে চিকিৎসক দেখাতে টিকিট কেটেছেন। তাদের মধ্যে ডেঙ্গু পজিটিভ এবং হাসপাতালে ভর্তি উপযোগী হওয়ায় ৯ জনকে ভর্তি দেওয়া হয়েছে। এর আগের দিন (মঙ্গলবার) সর্বমোট ৪৫০ রোগী টিকিট কেটে স্বাস্থ্য সেবা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭০ জন।
হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এখানে বর্তমানে ৫০০টি শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। রোগী ভর্তি রয়েছে ২৯৫ জনের মতো। এর বিপরীতে বিভিন্ন ‘ক্যাটাগরি’র চিকিৎসক রয়েছেন ৮৫ জন। তিন শিফটে নার্স রয়েছেন ১১৫ জন। আরও জনবলের জন্য আমরা আবেদন জানিয়েছি। তবে ২ থেকে ৩শ’রোগীর জন্য ৮৫ চিকিৎসক আমি মনে করি পর্যাপ্ত। হাসপাতালটি তো তথাকথিত হাসপাতাল নয়। এখানকার অবকাঠামোগত কিছু ত্রুটি থাকলেও আমাদের চিকিৎসক-নার্সরা আন্তরিকভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের এই মুহূর্তে ৮০০ শয্যা চালুর প্রস্তুতি নিয়ে রাখা আছে। যদি আরও বেশি প্রয়োজন হয় সেটিও আমরা চালু করতে পারব।
এমএম