ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গিজার মহা পিরামিড: মানব ইতিহাসের এক অমর নিদর্শন 

মো: আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ২৮ মে ২০২৫

গিজার মহা পিরামিড: মানব ইতিহাসের এক অমর নিদর্শন 

ছবিঃ সংগৃহীত

গিজার মহা পিরামিড, যা খুফুর পিরামিড নামেও পরিচিত, মিশরের গিজা মালভূমিতে অবস্থিত তিনটি প্রধান পিরামিডের মধ্যে বৃহত্তম এবং প্রাচীন বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে একমাত্র যা আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে। এটি শুধু একটি সমাধি নয়, বরং একটি প্রাচীন সভ্যতার প্রযুক্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও নকশাগত উৎকর্ষতার যুগান্তকারী উদাহরণ।

এই পিরামিডটি চতুর্থ রাজবংশের ফারাও খুফুর রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণকাল হিসেবে সাধারণভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৮৯-২৫৬৬ (খুফুর রাজত্বের সময়কাল) ধরা হয়। কিছু গবেষণায় সামান্য মতপার্থক্য থাকলেও অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক একমত যে এটি প্রায় ২০ থেকে ২৬ বছর ধরে নির্মাণ করা হয়েছিল। গিজার এই পিরামিডের উদ্দেশ্য ছিল ফারাও খুফুর দেহাবশেষ সংরক্ষণ এবং তার ঐশ্বরিক শক্তির প্রতিফলন ঘটানো। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে ফারাওরা মৃত্যুর পরে দেবতাদের সাথে যুক্ত হবেন এবং সেই জন্য তাঁদের দেহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পিরামিড ছিল সেই বিশ্বাসের বাস্তব প্রতিফলন।

গিজার মহা পিরামিড নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ২৩ লক্ষ পাথরের ব্লক, যেগুলোর গড় ওজন ছিল প্রায় ২.৫ টন। তবে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাথরের ওজন ১৫ টনেরও বেশি, এমনকি কিছু অত্যন্ত ভারী ব্লক প্রায় ৮০ টন পর্যন্ত ওজন ধারণ করে। পুরো কাঠামোর আনুমানিক ওজন ৬ মিলিয়ন টন। এর মোট আয়তন প্রায় ২.৬ মিলিয়ন ঘনমিটার বা ৯২ মিলিয়ন ঘনফুট। পিরামিডের উচ্চতা মূলত ছিল ১৪৬.৬ বা ১৪৬.৭ মিটার (৪৮১ ফুট), তবে সময়ের সাথে ক্ষয় এবং শীর্ষের পাথর হারানোর কারণে বর্তমানে এর উচ্চতা কমে এসেছে প্রায় ১৩৮.৫ মিটার (৪৫৪.৪ ফুট)। ভিত্তির প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩০.৩ মিটার বা ৭৫৫.৬ ফুট, যা প্রায় নিখুঁত বর্গাকার। আধুনিক নির্ভুল পরিমাপে অতি সামান্য (কয়েক সেন্টিমিটারের) পার্থক্য ধরা পড়লেও, প্রাচীন নির্মাণশৈলীর নিরিখে এটি বিস্ময়করভাবে নিখুঁত।

এই পিরামিড নির্মাণে প্রধানত স্থানীয় হলুদ বেলেপাথর ব্যবহৃত হয়েছে। তবে বাইরের মসৃণ আবরণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল উন্নত মানের হালকা রঙের চুনাপাথর, যা মিশরের তুরা অঞ্চল থেকে আনা হয়। ভেতরের কক্ষ ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যবহার করা হয়েছিল শক্ত গ্রানাইট, যা প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরের আসওয়ান থেকে আনা হয়েছিল। এই সব উপাদান পিরামিডটিকে সৌন্দর্য, শক্তি এবং জ্যামিতিক নিখুঁততার এক অতুলনীয় দৃষ্টান্তে পরিণত করেছে।

পিরামিড নির্মাণের পদ্ধতি এখনও সম্পূর্ণরূপে রহস্যে আবৃত। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব অনুযায়ী প্রাচীন মিশরীয়রা ঢালু পথ বা র‌্যাম্প ব্যবহার করে পাথরের ব্লকগুলোকে উচ্চতায় উত্তোলন করতেন। অন্যান্য ধারণার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সর্পিল পথ, কাঠের যন্ত্র এবং শ্রমিকদের সুসংগঠিত দলগত প্রচেষ্টার কথাও বলা হয়। তবে, কোনো একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিকে চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা যায়নি এবং এই বিষয়ে গবেষণা আজও অব্যাহত রয়েছে।

পিরামিডের অভ্যন্তরে রয়েছে তিনটি প্রধান কক্ষ—রাজার কক্ষ, রানীর কক্ষ এবং গ্র্যান্ড গ্যালারি। রাজার কক্ষের মধ্যে একটি বিশাল গ্রানাইটের কফিন রয়েছে, যা সম্ভবত ফারাও খুফুর দেহাবশেষ রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো। রানীর কক্ষের সঠিক ব্যবহার নিয়ে আজও বিতর্ক বিদ্যমান; কেউ কেউ মনে করেন এটি ফারাওয়ের মূর্তি বা ধর্মীয় প্রতীক সংরক্ষণের স্থান ছিল। গ্র্যান্ড গ্যালারি একটি দীর্ঘ, উঁচু পথ, যা রাজার কক্ষের দিকে উঠে গেছে এবং যা স্থাপত্যগত দিক থেকে অনন্য। এছাড়া রাজার কক্ষের উপরে পাঁচটি স্তরযুক্ত প্রকোষ্ঠ রয়েছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল উপর থেকে আসা পাথরের চাপ কমিয়ে ছাদের উপর সরাসরি চাপ না পড়তে দেওয়া।

গিজার পিরামিড কমপ্লেক্স কেবল একটি পিরামিড নিয়ে গঠিত নয়। এর আশেপাশে রয়েছে আরও ছোট পিরামিড, মন্দির, সমাধি এবং শ্রমিকদের বসতির ধ্বংসাবশেষ। এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় ও সামাজিক কেন্দ্র। আজ এই কমপ্লেক্স ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং মিশরের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এই অতুলনীয় নিদর্শনকে প্রত্যক্ষ করেন।

মধ্যযুগে কায়রো শহরের নির্মাণকাজে ব্যবহারের জন্য পিরামিডের বাইরের চুনাপাথরের আবরণ প্রায় সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হয়েছে। তবে এতকিছুর পরেও গিজার মহা পিরামিড আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সময়কে উপেক্ষা করে চিরন্তন সত্যের মতো। এটি শুধুই এক প্রাচীন সমাধি নয়—এটি এক অসাধারণ কীর্তি, এক সভ্যতার প্রতীক এবং বিশ্বমানবতার ইতিহাসে স্থায়ী বিস্ময়ের নাম।
 

নোভা

×