
ভুল নামে ডেকে ভুলে যাওয়া এক ফুলের সত্য পরিচয়। নাম তার কৃষ্ণকমল, রূপে-মাধুর্যে ভ্রম এনে দেয়। যাকে সবাই ঝুমকোলতা ভাবে, অথচ সে নিজেই এক মহাকাব্য, এক জটিল সৌন্দর্যের ভাষা। - রিজওয়ান করিম
সে কেবল এক ফুল নয়, সে যেন ইতিহাস ও বিশ্বাসের মাঝপথে দাঁড়িয়ে থাকা এক নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য। নাম তার কৃষ্ণকমল—দেখতে যেমন অনন্য, তার জন্মের গল্পটিও তেমনি আশ্চর্য। ফুলটির ইংরেজি নাম Passionflower হলেও এই 'প্যাশন' কোনো প্রণয়-উন্মাদনা নয়, বরং এক ধর্মীয় যন্ত্রণার রূপক।
কৃষ্ণকমল আমাদের দেশে এক অলংকারিক লতারূপে বাগানের দেয়াল ঘেঁষে উঠে এসেছে। কিন্তু এর আদি নিবাস বহু দূরে—দক্ষিণ আমেরিকার গভীর অরণ্যে। সেখানকার আদিবাসীরা অনেক আগেই চিনেছিল এর ঔষধি গুণ। ব্যথা কমানো, ঘুম আনা কিংবা মানসিক উদ্বেগ দূর করার জন্য তারা ব্যবহার করত এই গাছের নির্যাস।
১৬শ শতকে স্পেনীয় অভিযাত্রী ও খ্রিস্টান মিশনারিরা যখন দক্ষিণ আমেরিকায় পা রাখেন, তখন তারা এই ফুল দেখে চমকে ওঠেন। ফুলটির গঠন তাদের মনে করিয়ে দেয় এক ধর্মীয় দৃশ্য—'Passion of Christ', অর্থাৎ যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের কষ্ট ও আত্মত্যাগ।
তারা এই ফুলের প্রতিটি অংশে দেখেছিলেন প্রতীক:
পাপড়ির চারপাশের রিং যেন যিশুর মাথায় পরানো কাঁটার মুকুট।
পাঁচটি পুংকেশর — পাঁচটি পেরেক, যেগুলো দিয়ে যিশুকে বিদ্ধ করা হয়।
তিনটি গর্ভকেশর — তিনটি পেরেক বা ক্রুশের স্তম্ভ।
সরু পাপড়ির মাঝে থাকা বৃত্তাকার গঠন — খ্রিস্টের যন্ত্রণা ঘিরে থাকা দেবদূতদের শোক।
এই ভাবনার উপর ভিত্তি করেই তারা এর নাম দেয় Passionflower — যেখানে "passion" মানে প্রেম নয়, বরং 'প্যাশন অফ ক্রাইস্ট', অর্থাৎ ধর্মীয় যন্ত্রণা। ফুলটি হয়ে ওঠে ধর্মপ্রচারের একটি প্রতীক।
বাংলাদেশে এই ফুলের পরিচিতি আসে অনেক পরে, মূলত শৌখিন উদ্যানচর্চার মাধ্যমে। তবে বাঙালি মন এতে খুঁজে পায় ভিন্ন অর্থ—এই গঠন যেন রাসলীলার চিত্র। মাঝখানে কৃষ্ণ, চারদিকে গোপীদের নৃত্য, আর তার অলঙ্কারিক রূপ যেন স্বয়ং বৃন্দাবনের স্নিগ্ধতা।
এই কারণেই এর নামকরণ হয় “কৃষ্ণকমল”—একাধারে ভক্তি ও রূপের সমাহার। কেউ কেউ বলেন, পাপড়ির কেন্দ্রে থাকা গঠনটি কৃষ্ণের বাঁশি, আর পরাগরেণুগুলো তাঁর অলৌকিক রূপকে প্রতীকায়িত করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলার অনেক জায়গায় এই ফুলটি ভুল করে “ঝুমকোলতা” নামে পরিচিত। ঝুমকোলতা একেবারেই আলাদা একটি দেশজ উদ্ভিদ—সাদা, সরল গঠনের একটি ঔষধি লতা, যার ঝুলন্ত ফুল দেখতে অনেকটাই পিতলের ঝুমকার মতো।
দুই ফুলের গঠন ও উৎসে বিস্তর ফারাক থাকা সত্ত্বেও, কৃষ্ণকমলের অলংকৃত পাপড়িকে অনেকেই ভুল করে ঝুমকোলতা ভেবে নেন। এই বিভ্রান্তি শুধু উদ্ভিদের নামের প্রতি অবিচার নয়, বরং প্রকৃতির নিজস্ব পরিচয়ের ওপর আমাদের দৃষ্টির অসাবধানতাও বটে।
একদিকে ইউরোপীয় খ্রিস্টধর্মের প্রতীক, অন্যদিকে ভারতীয় ভক্তিরসের রূপক। এক ফুল, দুই মেরুর গল্প। এটি যেন ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ ও সংবেদনার এক অনন্য উপমা।
আজ কৃষ্ণকমল আমাদের বাগানে শোভা পায়, তবে তার গভীরে রয়েছে ইতিহাস, রূপক, এবং এক যুগপৎ বিশ্বাসের মিথ। তাই এই ফুল কেবল চোখের আরাম নয়, মনের আলোড়নেরও কারণ।
শিহাব