
‘নস্টালজিয়া’—একটি শব্দ, যেটি একসময় ছিল মানসিক রোগের নাম। আজ তা রূপ নিয়েছে এক গভীর আবেগে, যা মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করছে, কখনও প্রলুব্ধ করছে রাজনৈতিক বিভাজনের পথে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই আবেগটি হয়ে উঠেছে অনেক সময়েই বিপজ্জনক।
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এর সবচেয়ে আলোচিত প্রয়োগের উদাহরণ হলো ব্রেক্সিট। অনেকে মনে করেন, ব্রিটেন অতীতের গৌরবময় সময়ের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়েই ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' স্লোগানটিও ছিল রাজনৈতিক নস্টালজিয়ার একটি চূড়ান্ত প্রকাশ।
তবে নস্টালজিয়ার ব্যবহার রাজনীতিতে যতটা নতুন, আবেগ হিসেবে এর ইতিহাস ঠিক ততটাই পুরনো ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী।
একটি রোগের নাম ছিল ‘নস্টালজিয়া’
প্রথমবার ১৬৮৮ সালে সুইস চিকিৎসক জোহানেস হোফার এই শব্দটি ব্যবহার করেন একটি রোগের নির্ণয়ে। গ্রীক শব্দ 'নস্টোস' (বাড়ি ফেরা) এবং 'অ্যালগোস' (ব্যথা) থেকে আগত এই শব্দটি বোঝাত এমন এক মানসিক ব্যথা, যা বাড়ি থেকে দূরে থাকায় মানুষকে অসুস্থ করে তুলত।
তখনকার সময়ে এটি ছিল এক গুরুতর অসুখ। রোগীদের হত বিষণ্নতা, বিভ্রান্তি, আলস্য, এমনকি তীব্র দেহক্লান্তি। তাদের হার্টবিট অনিয়মিত হতো, ঘুম ব্যাহত হতো, ত্বকে ঘা দেখা দিত, আর কেউ কেউ তো এমনকি অনাহারে মৃত্যুবরণ করতেন!
এই রোগের সবচেয়ে বেশি প্রকোপ দেখা যেত শরৎকালে যখন ঝরা পাতায় সময়ের অন্তিমতা ও স্মৃতির ভার কাঁধে এসে বসতো।
এক সৈনিকের নস্টালজিয়ার গল্প
১৭৮১ সালে ইংল্যান্ডের এক ব্যারাকে চিকিৎসক রবার্ট হ্যামিল্টন এমন এক সৈনিককে পান, যিনি কেবল ‘বাড়ি ফেরার ব্যাকুলতা’ থেকে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। সেই সৈনিক তার গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতেই একপ্রকার পুনর্জীবিত হন। যখন তাকে বাড়ি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তখনই সে সুস্থ হতে শুরু করে। এই ঘটনাই বুঝিয়ে দেয়—নস্টালজিয়া ছিল কতটা গভীর ও শক্তিশালী এক মানসিক অবস্থান।
রূপান্তর ও আধুনিক চেহারা
নস্টালজিয়া ইউরোপ থেকে ছড়িয়েছে আমেরিকায়, আফ্রিকার দাসপ্রথার ইতিহাসেও এর ছায়া আছে। এমনকি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময়ও বহু সৈনিক মারা গেছেন ‘নস্টালজিয়া’ থেকে সৃষ্ট মানসিক ও শারীরিক জটিলতায়।
বিশ শতকে এসে একে হোমসিকনেস থেকে আলাদা করে দেখা শুরু হয়। এটি আর 'রোগ' নয়, বরং একটি আবেগ। মনোবিশ্লেষকরা প্রথমদিকে একে পশ্চাৎমুখী, অতি আবেগপ্রবণ মানুষদের বিষয় হিসেবে দেখলেও সময়ের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে।
তবে রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে নস্টালজিয়ার গ্রহণযোগ্যতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক সময় এটি যুক্তির বাইরে গিয়েও মানুষকে প্ররোচিত করে। ইতিহাসবিদ রবার্ট সন্ডার্স যেমন বলেছেন—“ব্রেক্সিট কোনো যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নয়, বরং এক মানসিক রোগ।
এখন ‘নস্টালজিয়া’ আর কোনো ওষুধে নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। এটি হয়ে উঠেছে এক আবেগ, এক মনস্তাত্ত্বিক চালিকা শক্তি যা ভালো ও খারাপ দুইভাবেই মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে।
তবে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় নস্টালজিয়া এখন আর নিছক ‘স্মৃতিচারণ’ নয়, বরং এক সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি, যা ব্যবহৃত হলে বদলে দিতে পারে ইতিহাসের মোড়ও!
মিমিয়া