ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র পারমাণবিক নয়, আল জাজিরায় মতামত প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ২৮ মে ২০২৫; আপডেট: ০৮:৪৩, ২৮ মে ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র পারমাণবিক নয়, আল জাজিরায় মতামত প্রকাশ

ছবি: সংগৃহীত

গত ২৬ মে (সোমবার) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় ‘The most dangerous weapon in South Asia is not nuclear’ শিরোনামে একটি মতামত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এটি লিখেছেন সায়েদা সানা বাতুল, যিনি একজন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাংবাদিক ও পোস্টডক্টোরাল গবেষক। তাঁর মতামতধর্মী এই প্রতিবেদনটির অনূদিত সংক্ষিপ্ত রূপ নিচে তুলে ধরা হলো-

মে মাসের সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ স্পষ্ট করে দিলো, এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়, বরং ‘ন্যারেটিভ’।

ভারত যখন ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করলো এবং পাকিস্তান পাল্টা ‘অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুস’ ঘোষণা করলো, গোটা বিশ্ব উত্তেজনার জন্য প্রস্তুত ছিল। বিশ্লেষকরা যেন নিঃশ্বাস ধরে রেখেছিল, সামাজিক মাধ্যমে ঝড় বয়ে গেল। কিন্তু যা ঘটলো, তা শুধুই সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

এটা এক যুদ্ধ ছিল ঠিকইকিন্তু শুধু ক্ষেপণাস্ত্রের নয়। এটি ছিল ‘ন্যারেটিভ যুদ্ধ’, যা পরিচালিত হয়েছে শিরোনাম, হ্যাশট্যাগ আর রাতের সংবাদকক্ষে। যুদ্ধের ময়দান ছিল গণমাধ্যম। গোলাবারুদ ছিল ভাষ্য। আর যে জিনিসগুলো হতাহত হয়েছে, তা হলোসূক্ষ্মতা, জটিলতা এবং সত্য।

ভারতীয় মিডিয়া ‘অপারেশন সিঁদুর’কে দেখালো ‘ন্যায়পরায়ণ প্রতিহিংসা’র ছাঁচে: পঁচিশ মিনিটে চব্বিশটি হামলা। ধ্বংস করা হয় নয়টি ‘সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি’। সাধারণ নাগরিকের কোনো হতাহতের খবর নেই। ভিলেনজইশ-ই-মুহাম্মদ, লস্কর-ই-তৈয়বা, আর বাহাওয়ালপুর ও মুজাফফরাবাদজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ‘সন্ত্রাসের কারখানা’—সবই ধূলিসাৎ বলে দাবি করা হয়।

সংবাদমাধ্যমের শিরোনামগুলো ছিল বিজয়োল্লাসে ভরা: ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক ২.০’, ‘ভারতীয় বাহিনীর গর্জন পৌঁছাল রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত’, ‘বিচার সম্পন্ন’। সরকারের মুখপাত্ররা এটিকে বললেন ‘পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত জবাব’যেখানে ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক নিহত হয়েছিলেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ঘোষণা দিলেন, ‘ওরা ভারতের কপালে আঘাত করেছিল, আমরা ওদের বুকে ঘা দিয়েছি।’

এটাই হলো ফ্রেমিং-এর কৌশল। কনস্ট্রাক্টিভিস্ট তত্ত্ব বলে, রাষ্ট্রগুলো কেবল স্বার্থ নয়, পরিচয়ের ভিত্তিতেও কাজ করে। আর সেই পরিচয় গঠিত হয় ভাষার মাধ্যমে। ভারতের ক্ষেত্রে, গণমাধ্যম এমন এক কাহিনি গড়ে তোলে, যেখানে সামরিক শক্তি মিশে যায় নৈতিক স্পষ্টতার সঙ্গে।

তিন দিন পর, পাল্টা জবাব দিলো পাকিস্তান। ঘোষণা করা হলো ‘অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুস’, অর্থ ‘লোহা নির্মিত প্রাচীর’। নামটাই সব বলে দেয়। এটি ছিল শুধু প্রতিশোধ নয়এটি ছিল ধর্মীয় ভাষ্যে গাঁথা এক জাতীয় বয়ান। শত্রু সাহস করেছে সীমা লঙ্ঘনের। জবাব হবে ঐশ্বরিক।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষিত হয় ভারতের সামরিক স্থাপনায়ব্রিগেড সদর দপ্তর, একটি S-400 সিস্টেম, এবং পাঞ্জাব ও জম্মুর সামরিক ঘাঁটিতে। পাক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ঘোষণা করেন, পাকিস্তান ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রতিশোধ’ নিয়েছেযে যুদ্ধে দেশটি আত্মসমর্পণ করেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এই বয়ানকে দেশপ্রেমের উচ্ছ্বাসে আরও জোরদার করে তোলে। ভারতের হামলাকে দেখানো হয় যুদ্ধাপরাধ হিসেবেমসজিদে হামলা, বেসামরিক হতাহত। ধ্বংসস্তূপ ও রক্তাক্ত দেহের ছবি ছাপা হয় ‘শহীদ’ শব্দযুক্ত ক্যাপশনের সঙ্গে। বিপরীতে, পাকিস্তানের জবাব ছিল যথার্থ, নৈতিক এবং অনিবার্য। পাকিস্তান যে জাতীয় পরিচয় নির্মাণ করল, তা হলোন্যায়সঙ্গত ভিকটিমহুড। আমরা শান্তিপ্রিয়, কিন্তু প্ররোচিত; সংযত, কিন্তু দৃঢ়। যুদ্ধ চাই না, কিন্তু ভয়ও করি না।

অদ্ভুত রকমের এক সমতা দেখা যায় দুই পক্ষের মধ্যে। উভয় রাষ্ট্রই নিজেকে দেখেছে রক্ষাকারী হিসেবে, কখনোই আগ্রাসী নয়। উভয় পক্ষই দাবি করেছে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব। উভয়েই বলেছে, শত্রুই আগে হামলা করেছে। উভয়েই বলেছে, তাদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না।

 

সূত্র: আল জাজিরা।

রাকিব

×