
বাংলাদেশের ভূমি মালিকানা ও জমি সংক্রান্ত অধিকাংশ জটিলতা এবং মামলা-মোকদ্দমার মূলে থাকে খতিয়ানের তথ্যভ্রান্তি বা অস্পষ্টতা। অথচ একজন নাগরিকের উচিত তার জমির প্রকৃত খতিয়ান সম্পর্কে ধারণা থাকা। কারণ সঠিক খতিয়ানের তথ্য জমির মালিকানা ও দখলের স্বত্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে মোট পাঁচ ধরনের খতিয়ান প্রচলিত রয়েছে, যার প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা পরিচিতি, ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্য।
নিচে বাংলাদেশের খতিয়ান ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ ও খতিয়ান চেনার উপায় তুলে ধরা হলো।
সি, এস (CS) খতিয়ান: প্রথম জরিপের নির্ভুল দলিল
সি, এস খতিয়ানের পূর্ণরূপ হলো Cadastral Survey। এটি ব্রিটিশ আমলে ১৮৮৮ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুত হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় অনুসারে, জরিপটি ১৮৮৭ সালে শুরু হয়। এটিই উপমহাদেশে প্রথম ভূমি জরিপ হিসেবে স্বীকৃত। জরিপে জমির মালিকানা, আয়তন, শ্রেণি, খাজনার পরিমাণ ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয় এবং দাগ নম্বর অনুযায়ী খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।
এই জরিপের খতিয়ান এতটাই নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য যে, এখনো অনেক মামলার রায়ে সি, এস খতিয়ানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। জমিদারদের নাম খতিয়ানের উপরিভাগে এবং রায়তের নাম নিচে লেখা থাকতো। জরিপের নকশা ও খতিয়ান পি-৭০ শীটে প্রস্তুত হতো।
সি, এস খতিয়ান চেনার উপায়:
১. খতিয়ানটি লম্বালম্বিভাবে থাকবে
২. উভয় পৃষ্ঠায় লেখা থাকবে
৩. প্রথম পৃষ্ঠায় জমিদার এবং প্রজার নামে দুইটি ভাগ থাকবে
৪. উপরের দিকে লেখা থাকবে “বাংলাদেশ ফরম নং ৫৪৬৩”
৫. অপর পৃষ্ঠায় “উত্তর সীমানা” কলাম থাকবে
এস, এ (SA) খতিয়ান: জমিদার বিলুপ্তির পরবর্তী রেকর্ড
এস, এ খতিয়ানের পূর্ণরূপ হলো State Acquisition খতিয়ান। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ২৭ থেকে ৩১ ধারা অনুসারে ১৯৫৬-৬০ সালে এই খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়। জমিদার ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর ভূমির মালিকানার রেকর্ড নতুনভাবে সংরক্ষণের জন্য সরকার এই জরিপ চালায়।
এই খতিয়ান হাতে লেখা হয় এবং জমিদারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত হওয়ায় তাতে কিছু ত্রুটি ছিল। এজন্য পরবর্তী সময়ে আর, এস জরিপ চালানো হয়। এস, এ খতিয়ানকে অনেক সময় পি, এস (Pakistan Survey) হিসেবেও অভিহিত করা হয় কারণ এটি পাকিস্তান আমলে সম্পন্ন হয়েছিল।
এস, এ খতিয়ান চেনার উপায়:
১. খতিয়ানটি সবসময় আড়াআড়িভাবে থাকে
২. সম্পূর্ণ খতিয়ান হাতে লেখা হয়
৩. এতে পূর্ববর্তী (সি, এস) খতিয়ান নম্বর এবং হাল নম্বর উল্লেখ থাকে
৪. এটি এক পৃষ্ঠার হয়ে থাকে
আর, এস (RS) খতিয়ান: হালনাগাদকরণে নির্ভরযোগ্য
আর, এস খতিয়ানের পূর্ণরূপ হলো Revisional Survey। সি, এস ও এস, এ জরিপের দীর্ঘ ব্যবধান ও ত্রুটির কারণে সরকার ১৯৬০-এর দশকে নতুন করে মাঠ জরিপের উদ্যোগ নেয়, যা আর, এস নামে পরিচিত। এই জরিপে সরেজমিনে জমির মালিক, দখলদার, প্রকৃতি ও পরিমাণ যাচাই করে খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।
এই খতিয়ান তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য ও আদালত কর্তৃক গ্রাহ্য হয়। বর্তমানে অধিকাংশ জায়গায় এ খতিয়ানের ওপর ভিত্তি করে ভূমির লেনদেন ও মালিকানা নির্ধারণ করা হয়।
আর, এস খতিয়ান চেনার উপায়:
১. ফর্মের ডান পাশে “রেসার্তে নং” লেখা থাকে
২. পুরনো খতিয়ান দুটি পৃষ্ঠায় হলেও এখন এক পৃষ্ঠায় হয়
৩. খতিয়ানটি লম্বালম্বিভাবে থাকে
বি, এস খতিয়ান / সিটি জরিপ: সর্বশেষ ও ডিজিটাল রেকর্ড
১৯৯৮-৯৯ সালে ঢাকার শহরাঞ্চলকে ঘিরে চালু হওয়া আধুনিক জরিপ হচ্ছে বি, এস খতিয়ান, যা সিটি জরিপ নামেও পরিচিত। এটি আধুনিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় এবং প্রিন্টেড কপি ইস্যু করা হয়। এটি এখনো বিভিন্ন এলাকায় চলমান রয়েছে এবং ভবিষ্যতের জমি ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বি, এস খতিয়ান চেনার উপায়:
১. এই খতিয়ানে মোট ৯টি কলাম থাকবে
২. জমির ধরন যেমন নাল জমি, পুকুর ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে
দিয়ারা জরিপ: নদী তীরবর্তী অঞ্চলের খতিয়ান
দিয়ারা জরিপ মূলত জেগে ওঠা নতুন চর বা নদীর কারণে সৃষ্ট ভৌগলিক পরিবর্তনের ফলে জরিপের প্রয়োজন হলে চালানো হয়। জেলা প্রশাসকের চাহিদায় এই জরিপ করা হয় এবং তা মূলত নদী বা সাগরের তীরবর্তী এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
ভূমির প্রকৃত মালিকানা যাচাই, কেনাবেচা, উত্তরাধিকার কিংবা আদালতের মামলায় যে কোনো নাগরিকের জন্য সঠিক খতিয়ান জানা অত্যন্ত জরুরি। আপনি কোন ধরনের খতিয়ানের আওতায় পড়েন তা বোঝা গেলে জমি সংক্রান্ত যেকোনো আইনগত প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। সুতরাং, প্রতিটি নাগরিকের উচিত তার জমির খতিয়ান যথাযথভাবে যাচাই করে সংরক্ষণ করা।
সূত্র:https://tinyurl.com/4jyt4886
আফরোজা