ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

লোকউৎসবের মঞ্চে যাত্রার পর্দা নামছে, ইউটিউব-টিভির আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ নাট্যজগৎ

এলেন বিশ্বাস, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা 

প্রকাশিত: ০০:২৩, ২৩ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০০:২৪, ২৩ জুলাই ২০২৫

লোকউৎসবের মঞ্চে যাত্রার পর্দা নামছে, ইউটিউব-টিভির আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ নাট্যজগৎ

ছবি সংগৃহীত

এক সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের প্রাঙ্গণে বাঁশের খুঁটি আর রঙিন কাপড়ে বানানো মঞ্চে শুরু হতো যাত্রাপালা। চারপাশে ভিড় করত শত শত দর্শক। এখন সেই দৃশ্য শুধুই স্মৃতি। স্থানীয় উৎসবগুলোর আবহে এক সময় ছিল যাত্রা, পালা, গ্রামীণ নাটক বা কবিগানের জয়জয়কার—কিন্তু আজ এসব প্রায় বিলুপ্ত।

স্থানীয় লোকসংস্কৃতির প্রাণ ছিল যাত্রা। বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন এসব নাট্যরূপ যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠান, চড়ক পূজা, মেলা বা মহরম—প্রতিটি উৎসবেই যাত্রাদলের ডাক পড়ত। কিন্তু এখন সেই ডাক নেই, নেই সেই দর্শকও।

টিভি চ্যানেলের নাটক, সিরিয়াল ও ইউটিউবের স্ক্রিপ্টেড কন্টেন্ট এখন মানুষের সময় দখল করে নিয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন স্মার্টফোনে নাটক দেখে, ফেসবুকে রিল দেখে। ফলে উৎসব মানেই গানবাজনা আর ডিজে পার্টি—সাংস্কৃতিক উপস্থাপনাগুলো একঘেয়ে হয়ে পড়েছে।

"আগে পয়লা বৈশাখ, মহরম বা ওরস উপলক্ষে ১০-১৫ দিনের জন্য বুকিং থাকত। এখন তো এক মৌসুমে একটা শো জোটে না। ছেলে-মেয়েরা বলে, নাটক না দেখে ইউটিউবে 'শর্টফিল্ম' দেখে মজা বেশি!"

নতুন প্রজন্ম যাত্রা বা গ্রামীণ নাটকের সংলাপ শিখতে চায় না। আগের মতো দল গড়তে গেলেও শিল্পী মেলে না। কারণ, এই পেশায় টিকে থাকা কষ্টসাধ্য, আয়-রোজগারও অনিশ্চিত।

যাত্রানৃত্যশিল্পী রিনা আক্তার বলেন, "আমরা মঞ্চে নাচতাম, গাইতাম। এখনকার মেয়েরা বলে—'এতে লাভ কী? ইউটিউবে রিল করলেই লাখ ভিউ'।"

সংস্কৃতির এই অবক্ষয়ের ফলে সমাজ হারাচ্ছে তার রূপান্তরশীল বয়ানগুলো। যাত্রায় যেমন মিথ, ইতিহাস, প্রেম, সমাজবিচার থাকত—তেমনই থাকত ভিন্ন মতামতের জায়গাও। আজকের ডিজিটাল কন্টেন্টে সেটা নেই। ফলে সমাজ ধীরে ধীরে একঘেয়ে বিনোদনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

সংস্কৃতি কর্মীরা বলছেন—যাত্রা বা নাটক বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে নাট্যচর্চা এবং স্থানীয়ভাবে নাট্যউৎসব আয়োজন। ইউনিয়ন বা পৌরসভা থেকে যেন বছরে অন্তত একবার হলেও নাটক বা যাত্রার আয়োজন হয়—এমন দাবিও উঠেছে।

লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য হারালে হারাবে সমাজের আত্মপরিচয়। প্রযুক্তি আমাদের হাতে আধুনিকতা এনে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মাটির টান ও মানুষের মুখের গল্পগুলো যদি হারিয়ে যায়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে শেকড়হীন। তাই এখনই সময় গ্রামীণ নাট্যজগৎকে নতুন করে মূল্যায়নের।

রাজু

×