
জীবন কখনো যন্ত্রণার, কখনো উপভোগের, কখনো হতাশা-ব্যর্থতার
জীবন কখনো যন্ত্রণার, কখনো উপভোগের, কখনো হতাশা-ব্যর্থতার কখনোবা সাফল্য-উদযাপনের। সবমিলিয়ে জীবনের বাস্তবতা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন সুরতে ধরা দেয়। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিটশে বলেছেন, ‘বেঁচে থাকা মানে কষ্ট পাওয়া, বেঁচে থাকা মানে কষ্টের কিছু অর্থ খুঁজে নেওয়া।’ জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট ভিক্টর ই. ফ্রাঙ্কল যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের কবল থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লেখেন যার নাম ‘ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং’। বইটিতে তিনি যা বলতে বলতে চেয়েছেন তার সারমর্ম হলো মানুষের যখন বেঁচে থাকার কারণ থাকে তখন মানুষ শত কষ্ট-দুর্দশা সহ্য করে হলেও বাঁচতে পারে।
উত্তরাধুনিক সময়ে কিভাবে মানুষ ধীরে ধীরে তার জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে এবং তার বেঁচে থাকার কারণগুলো সংকীর্ণ করে ফেলছে এই দর্শনকে উপজীব্য করে তৈরি হয়েছে ‘লালাবাই’ নামক একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ‘ফ্রেমে ফ্রেমে আগামী স্বপ্ন’ স্লোগানে গত ৭, ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ১৬তম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে ‘লালাবাই’। শিশু নির্মাতা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করা এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটির গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন শেখ লোকমান গালিব। মূলত গালিবের একক অভিনয়ের মাধ্যমেই আগিয়েছে চলচ্চিত্রটির গল্প।
চাকরি হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত এক যুবক একে একে তার বেঁচে থাকার সবগুলো অর্থ হারিয়ে ফেলছে। বেঁচে থাকার মতো শুধু একটা কারণই তার হাতে অবশিষ্ট রয়েছে। বিদেশ থেকে তার প্রেমিকা ফিরে এসে তার জীবনটা আবার গুছিয়ে নিতে সাহায্য করবে। ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে কেউ একজন তাকে প্রবল আকর্ষণে মৃত্যুর দিকে ডাকছে। সে তার প্রেমিকার অপেক্ষায় আত্মহত্যার প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। হঠাৎ তাকে মোবাইল ফোনে কেউ একজন জানাল তার প্রেমিকা একটি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। প্রেমিকার মৃত্যুর সংবাদের পর সে তার নিজের বেঁচে থাকার অর্থটাও হারিয়ে ফেলে।
নিটশে কিংবা ভিক্টর ই. ফ্রাঙ্কলের মতো গালিবের আগ্রহের জগৎ- জীবন দর্শন এবং জীবনের অর্থ খুঁজে ফেরা। সিনেমায় তিনি ফুটিয়ে তুলতে চান বেঁচে থাকার বৈচিত্র্যময় দিকগুলো। উত্তরাধুনিক সভ্যতা আমাদের চাকচিক্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে আমাদের প্রতিনিয়ত টানছে। আমরা বুঝে-কিংবা না বুঝে সে ডাকে সাড়া দিয়ে এর ভিতর প্রবেশ করে অন্তঃসারশূন্যতা দেখে এক পর্যায়ে হারিয়ে ফেলছি বেঁচে থাকার অর্থ কিংবা মুখোমুখি হচ্ছি চরম অস্তিত্ব সংকটের।
গালিব বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি শখ থেকেই নিজেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে যুক্ত করেছেন। তবে পড়াশোনা শেষ করে অভিনয় ও চলচ্চিত্র নির্মাণকে পেশা হিসেবে নিতে চান গালিব। গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হাতে বেশ অবসর ছিল গালিবের। ক্লাস শুরু হতে তখনো দুই-তিন মাস বাকি। এ সময়টাতেই গালিব তার পরিচিত দুজন ছোটভাই অমিত্রাক্ষর বিশ্বাস ও আকরামুল হাসান রিয়াদকে নিয়ে শুরু করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানোর কাজ। লালাবাইয়ের পরিচালনায় ছিলেন অমিত্রাক্ষর বিশ্বাস এবং সিনেম্যাটোগ্রাফিতে ছিলেন অমিত্রাক্ষর বিশ্বাস ও আকরামুল হাসান রিয়াদ।
লালাবাইয়ের গল্প লেখার পেছনের গল্প বলতে গিয়ে গালিব বলেন, গল্প লেখার আগে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করি। আমাদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট অনেক কম ছিল। শূটিং স্পট হিসেবে আমাদের হাতে ছিল মূলত অমিত্রাক্ষরের বাসার ছাদ। ওর বাসার ছাদকে মাথায় রেখেই মূলত গল্পটা লেখা।
নিজের প্রথম কাজের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত গালিব তার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘প্রায় একশত সিনেমার মধ্যে বেস্ট হওয়া আমার জন্য খুবই আনন্দের কারণ প্রথমবারের মতো এবং প্রথম চেষ্টায়ই আমরা বেস্ট ফিল্মের পুরস্কার জিতেছি। এর সঙ্গে ভালোলাগা কাজ করছে যখন দেখছি মানুষজন আমাদের কাজটা পছন্দ করছে।’
চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের সমাপনী দিনে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শেষে লালাবাই-এর নির্মাতাদের মাঝে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মোরশেদুল ইসলাম, সভাপতি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাধারণ সম্পাদক মুনিরা মোরশেদ মুন্নী, উপদেষ্টা ড. ইয়াসমিন হকসহ আরও অনেকে।