
ইউটিউবার, টিকটক কিংবা ফেসবুকে প্রতিনিয়তই ভাইরাল হচ্ছেন অনেকে। তারা ভাইরাল হলেই পরবর্তী সময় সহজেই নাম লেখাচ্ছেন অভিনয়শিল্পী হিসেবে। ভিউকে টার্গেট করে এসব ভাইরাল ব্যক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন প্রযোজক ও পরিচালকরা।
এদের দিয়ে এক শ্রেণির প্রযোজক ও নির্মাতারা গানে মডেল করছেন কেউ নাটকের অভিনয় করাচ্ছেন। এখন অনেক নাটকেই টিকটক তারকা বা ভাইরাল ছেলেমেয়েদের দেখা যায়। একই রকম মিউজিক ভিডিওতে টিকটক তারকাদের ভরপুর অংশগ্রহণ থাকছে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা অভিনয়শিল্পীরা ও সংগীত সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ বলছেন, এই চর্চায় সহজে শিল্পী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হলে, যে কেউ যে কোনো উপায়ে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করবেন, যা শোবিজকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যাবে। কেউ অভিনয় শিখতে চাইবেন না।
অভিনেত্রী নাবিলা ইসলাম বলেন, ‘এটা রুচির দুর্ভিক্ষের কারণে হচ্ছে। যে কেউ এভাবে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। তারা যেভাবে ভাইরাল হচ্ছেন, সেভাবেই তাদের অভিনয়ে দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে অন্যরাও প্রতিনিয়ত সুযোগ পাচ্ছেন। এভাবে একটা সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এটা দিন দিন সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্য কিছু ভিউয়ের জন্য শিল্পকে ছোট করা হচ্ছে। এটা যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা উচিত।’
তরুণ অভিনেতা আবদুল্লাহ আল সেন্টু আক্ষেপ নিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা শিল্প দিয়ে টাকা উপার্জন করতে শিখি নাই, আমরা শিখেছি কীভাবে সহজ লাইনে টাকা উপার্জন তৈরি করা যায়। এই সবের জন্য আমি-আপনি-আমরা সবাই দায়ী। এভাবে চলতে থাকলে শিল্পী তৈরি হবে না। কেউ আর অভিনয় শিখে আসবেন না।’
খবর নিয়ে জানা যায়, এর আগে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করে আলোচিত একজন অভিনয়ে এসেছিলেন। এছাড়া অসুস্থ অঙ্গভঙ্গি করে, অসংলগ্ন কথা বলে একাধিক ব্যক্তি অভিনয়ে এসেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন হিরো আলম, ইয়াসিন অপু, মিরাজ খান, সাবরিনাসহ অনেকে। অভিনেতা লিমন মনে করেন, ‘এভাবে যদি কেউ অভিনয়ে সুযোগ পায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম কেন সুস্থ ধারায় অভিনয়ে আসার চিন্তা করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের নৈতিক অবক্ষয় বন্ধ হয়, সামনে কেউ আর আর্ট কালচার শিখতে চাইবে না। যে কোনো পদ্ধতিতে ভাইরাল হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাতা, দুজন টিকটকারকে দিয়ে নাটক নির্মাণ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভাই বাধ্য হয়ে নিয়েছিলাম। নাটকের ভিউ লাগবে, প্রযোজকের ডিমান্ড। আমাকে তো কাজ করে খেতে হয়, কিছু বললে এই কাজ অন্যজনকে দিয়ে করাবে। এই জন্য একবারই করেছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম, তারা আসলে শিল্পী হওয়ার জন্য নয়, নিজেকে চেনানোর জন্যই মিডিয়ায় এসেছেন। তাদের বেশির ভাগের মধ্যেই শৈল্পিক চিন্তা নেই, ভাইরাল চিন্তাই মাথায় কাজ করে।’
পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘দিন দিন ভিউ-দৌড়ে নাটক ব্যবসা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই বিজনেসে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পচর্চা। এখানে ডিরেক্টরদের কিছুই করার থাকছে না। কারণ প্রযোজক যাকে দিয়ে ব্যবসা হবে, তাকে কাজে নেবেন। ডিরেক্টরদের চুপ থাকতে হচ্ছে। আবার রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা তুললেও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এখন অভিনয় করার অধিকারও সবার আছে। কাউকে না করা যাবে না। এটা থেকে নাট্য অঙ্গনের পরিত্রাণ কীভাবে সম্ভব, সেটা আমি নিজেও জানি না।’ ২০১৬ সালে ছোট ভিডিও শেয়ারের সামাজিক মাধ্যম টিকটক যাত্রা শুরু করে। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয় এই মাধ্যমটি। এই টিকটক তারকাদের মধ্যে যারা গানে মডেল হচ্ছেন তারা আবার সব গান যে প্রমোট করছেন এমন নয়। চটুল ও মসলাদার কথা ও সুরের গানকেই তারা প্রাধান্য দিচ্ছেন। যে কারণে ভালো কথা ও সুরের অনেক গান আড়ালে চলে যাচ্ছে। শ্রোতাদের কাছে ঠিকভাবে সে গান যাচ্ছে না বলে মনে করছেন কেউ কেউ। টিকটকারের এই ‘দৌরাত্ম্য’ নিয়ে সুরকার ও শিল্পী নকীব খান বলেন, আমি মনে করি টিকটক গানের আবেদন নষ্ট করে। টিকটকের সঙ্গে গানের কোনো সম্পৃক্ততা থাকতে পারে না। যারা টিকটকের মাধ্যমে গানকে প্রমোট করে সেটি তাদের ব্যপার। আরও সুন্দর ও সঠিক মাধ্যমেও গানকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
প্যানেল